টিকে থাকা নয়, বেঁচে থাকার রসদ জোগাবে ‘রাস’

ছবি: রাস

পরিচালনা: তথাগত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, অনসূয়া মজুমদার, দেবলীনা কুমার, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, রণজয় বিষ্ণু, শঙ্কর দেবনাথ, অনির্বাণ চক্রবর্তী, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, অপ্রতীম চট্টোপাধ্যায় 

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

 

মানিকপুর, একেবারে অজপাড়া গাঁ, সেই গ্রামে চক্রবর্তীদের বাড়ি। মানে সে পেল্লায় রাজপ্রাসাদ। সঙ্গে আমবাগান, পুকুর মিলিয়ে তা কয়েক বিঘা তো বটেই। ভাবছেন বোধহয় সে সব দেখভাল করার মানুষ নেই। তরুণ প্রজন্মের সকলেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। বছরে একবার পালাপার্বণে দেশের বাড়িতে মুখ দেখাতে আসে। সে গুড়ে বালি! নয় নয় করে এ বাড়িতে এখনও দু’বেলা জনাদশের পাত পড়ে। একই হেঁশেলে রান্না হয়। ভাব-ভালবাসা-তর্কাতর্কি গলা জড়াজড়ি করে থাকে। চক্রবর্তী পরিবারের গৃহকর্ত্রী, বাড়ির ছোটদের কাছে দিদামা (অনসূয়া) কাউকেই তাঁর আঁচলের ছায়া থেকে বঞ্চিত হতে দেননি। শুধুমাত্র মেজছেলে (সুদীপ) এবং এক নাতি ছাড়া। মেজপুত্রবধূ অকালে মারা যাওযার পর ছেলেকে নিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে যায় সে। মায়ের অনুরোধ, এক দাদা, এক বোন, দুই ভাই, বৌদি কিংবা ভাইপো-ভাইঝিদের ভালবাসাতেও তাঁর মন গলেনি। ছেলেকে তিনি শিক্ষিত করতে চান। শহুরে আদবকায়দা শিখিয়ে, বিলেতে পাঠিয়ে সমাজের চোখে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে চান।




দিন-মাস-বছর কাটে, সোমনাথ (বিক্রম) বড় হয়ে ওঠে। কর্মসূত্রে পাকাপাকিভাবে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার আগে বাবার পছন্দের পাত্রীর সঙ্গে আইনি বিয়ে সেরে ফেলার দিনও স্থির হয়ে যায়। কিন্তু সোমনাথের মন থেকে তার দিদামার স্মৃতি মোছে না। তাই দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে একটি বারের জন্য সে ছুঁয়ে দেখতে চায় তার ফেলে আসা ছেলেবেলাকে। ঘটনাচক্রে চক্রবর্তী বাড়িতে তখন রাস উৎসবের প্রস্তুতি তুঙ্গে। একদিকে পুজোর জোগাড়, অন্য দিকে নাচ-গান-নাটকের মহড়া, সব মিলিয়ে বাড়িতে কাকপক্ষী বসার উপায় নেই। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে গোবরে পা পিছলে, পানা-পুকুরে ডুবে, ভিজে পোশাকে সোমনাথ এসে পৌঁছয় তার দেশের বাড়িতে।

আরও পড়ুন: মুশকিল আসান রাখি, দোসর শিবপ্রসাদ

রাস মূলত বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। উপনিষদে বলা আছে, ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নয়। আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই রসের ঘনীভূত আধার। ‘রস’ থেকে হয়তো রাস উৎসবের নামকরণ হয়নি। তবে কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে রাধাকৃষ্ণের এই প্রেমরসের ধারায় অবগাহন করেন নারী, পুরুষ সকলেই। তথাগতর ছবি ‘রাস’-এর (Raas) আধার হল সোমনাথ, ওরফে সোম। সঙ্গে রয়েছেন রাধারূপী রাই (দেবলীনা)। বিক্রম এখন বড়পর্দায় অন্যতম পরিচিত ও সফল মুখ। তবে ইদানীং অ্যাকশন ছবিতেই বেশি দেখা যাচ্ছে তাঁকে। এখানে তিনি একেবারে অন্য রূপে। বেশ কয়েকটি ছবিতে বিভিন্ন ছোট বড় ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেবলীনা। কিন্তু মুখ্য চরিত্রে এই প্রথম। জুটি হিসেবে তাঁদের প্রথম ছবিতে বিক্রম এবং দেবলীনা দুজনেই দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। এ ছাড়াও ছবিতে রয়েছেন বহু স্বনামধন্য অভিনেতা অভিনেত্রী। প্রত্যেকের অভিনয় সাবলীল বলা বাহুল্য। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পরিপূরক বলা চলে।

আরও পড়ুন: আব্বুলিশ, টেথোস্কোপ আর তিন খুদের স্বপ্ন

এ ছবির পরতে পরতে লেগে রয়েছে গাঁ-গঞ্জের মেঠো ঘ্রাণ। পরিস্থিতির চাপে পড়ে গ্রাম থেকে বড় শহরে কিংবা বিদেশে বসবাস করা মানুষ জানেন বুকের মধ্যে তোলপাড় করা সেই গন্ধ আসলে কেমন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে বসেও রাসের মতো একটি ‘সর্বজনীন’ তকমা না পাওয়া, তুলনায় আড়ম্বরহীন উৎসবের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। টাইমমেশিনে চড়ে একছুটে পৌঁছে যাওয়া যায় ফেলে আসা দিনগুলোয়। বড় বাজেটের বাংলা ছবিতে চোখসওয়া দুর্গাপুজো কিংবা বিয়ের দৃশ্য এড়িয়ে পরিচালক বাংলার প্রাচীন এই উৎসবটি বেছে নিয়ে মন্দ করেননি। কিন্তু এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যখন গোটা ছবির চিত্রনাট্য সাজালেন, তখন রাধাকৃষ্ণের আরাধনার কোনও দৃশ্য কেন রাখা হল না কেন? শুধু রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আর তা কেন্দ্র করে নাচগান হলেই তো রাস উৎসব পালন হয় না।  

‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ বলে বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। ‘রাস’ যেহেতু যৌথ পরিবারের গল্প তাই সেখানে কলাকুশলীর সংখ্যা অনেক। তা সত্ত্বেও তথাগত ‘গাজন’ নষ্ট হতে দেননি। ছবি দেখতে বসলে একবারের জন্যও কাউকে অতিরিক্ত বলে মনে হবে না, তা একেবারেই কাহিনির এবং চিত্রনাট্যের গুণে। তবে ছবির শেষভাগটি টানটান হলে আরও ভাল হত। ছবিতে মনোজ মুরলী নায়ারের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান মন ছুঁয়ে যায়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা যে শুধুমাত্র নারী-পুরুষ কিংবা পার্থিব জিনিসে আবদ্ধ থাকতে পারে না, সে কথা টের পেয়েছিলেন স্বয়ং রবি ঠাকুরও। সে ‘রস’ থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত হতে দেননি। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে ব্রজবুলি ভাষায় লিখেছিলেন ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। রাস উৎসব উপলক্ষে সাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বদলে সোম এবং রাইয়ের কণ্ঠে তেমন কিছুর ব্যবহার হলে এক অন্যরকম আবহের সৃষ্টি হতো। চিত্রনাট্য নিয়ে আরও একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে সে সব খামতি এড়িয়ে যাওয়া যেত। ছোটখাটো কিছু ভুলভ্রান্তি বাদ দিলে পারিবারিক ছবি হিসেবে ‘রাস’ দর্শকের মনে গেঁথে থাকার মতো একটি ছবি। শহুরে জীবনযাপন, কর্পোরেট আদবকায়দা এবং ‘নিউক্লিয়ার’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে প্রাণ ভরে মাটির স্নিগ্ধ বাতাস নিতে হলে একবার ‘রাস’ দেখে আসাই যায়।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Ankeeta

Sleep, travel, eat, repeat! Anchor, presenter, news reader, editor by profession. Long drives and exploring life are my favorite options. Stuck between food and fitness. Intoxicated by music. Painting, singing, photography and Rabindranath are my soulmates

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *