সেরা প্রাপ্তি সঙ্গীত
সিরিজ়: তানসেনের তানপুরা
পরিচালনা: সৌমিক চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে: বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, রূপসা চট্টোপাধ্যায়, রজত গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়চৌধুরী, জয়তী ভাটিয়া, সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুরাধা মুখোপাধ্যায়, অঙ্গনা রায়
দৈর্ঘ্য: ৩ ঘন্টা ৪৪ মিনিট (দশ পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
মোঘল সম্রাট আকবরের সভাগায়ক মিঞা তানসেনের কন্ঠের মূর্ছনায় মেঘের বুক চিরে নামত বারিধারা, পৃথিবী হতো স্নাত। লোকগাথায় পরিণত সেই কাহিনীকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে হিন্দি ছবিও। সেই একই কাহিনীকে বিষয়বস্তু করে সৌমিক পরিচালনা করেছেন ‘তানসেনের তানপুরা’। তবে এই মিউজ়িক্যাল থ্রিলার এক অন্য গল্প বলে। শোনা যায় আকবর নাকি একবার তানসেনের গান শুনে তৃপ্ত হয়ে তাঁকে একটি তানপুরা উপহার দিয়েছিলেন। এই তানপুরার মাথায় লাগানো ছিল এক মহামূল্য হীরে। পরবর্তীকালে গুরুশিষ্য পরম্পরায় হাতবদল হলেও ইতিহাসের পাতায় এই তানপুরার রহস্যের উন্মোচন হয়নি। হারিয়ে যাওয়া সেই সুরযন্ত্রের সন্ধানেই এই সিরিজ়।
গল্পের শুরুতে সেই চিরচেনা সংঘাত, প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য সঙ্গীতের আদিম লড়াই। কিন্তু পুরাণ অনুসারে সাত সুর, বাইশ শ্রুতি, ছয় রাগ এবং ছত্রিশ রাগিণী ব্যতীত কোনও সুরসৃষ্টি যে অসম্ভব, সেই কথাই মনে করিয়ে দেন এই সিরিজ়ের কাহিনীকার সৌগত বসু।
গল্পের পটভূমি আনন্দগড়। সেখানকার প্রখ্যাত গায়ক, পণ্ডিত কেদারনাথ মিশ্র (রজত) বংশপরম্পরায় তানসেনের তানপুরার মালিক। প্রিয় শিক্ষার্থীদের বিখ্যাত করার চেয়ে শিল্পী হিসেবে দেখতেই বেশি আগ্রহী তিনি। তাই কড়া অনুশীলন ও অনুশাসনে তিনি গড়ে তুলেছেন এমন এক গুরুকুল যেখানে নিজের মেয়ে মধুমন্তীর পাশাপাশি বন্যাদুর্গত ১২ জন ছেলেমেয়েকেও তিনি সঙ্গীতশিক্ষা দেন। সুযোগ্য শিল্পী তৈরি করে তাঁর হাতেই তানপুরা তুলে দেবার বাসনা কেদারনাথের। তার একমাত্র কন্যাও সেই তালিকায় স্থান পায়। তানসেনের তানপুরার তারে গুপ্ত সংকেত লিখে তিনি যাচাই করে নিতে চান কে হবে সেই সুরযন্ত্রের অধিকারী। ঘটনাচক্রে তিনি মারা যাওয়ার পর সেই তানপুরার দাবিদার অজানাই থেকে যেত, যদি না দশ বছর পর তার নাতনি শ্রুতি (রূপসা) ও তার বন্ধু আলাপ (বিক্রম) সঙ্গীতশিক্ষার উদ্দেশ্যে আনন্দগড়ে আসত। এখান থেকেই শুরু হয় সেই তানপুরার খোঁজ।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
চিত্রনাট্যের বুনোট ও পরিচালনা সুন্দর। একটি পর্বের শেষ এবং অন্য পর্বের শুরুর মাঝে এতটুকু ফাঁক রাখেননি সৌমিক। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কাহিনী এগিয়েছে অতীত ও বর্তমানকে কেন্দ্র করে। সঙ্গে অবশ্যই বজায় থাকে সাসপেন্স। সঙ্গীতের সঙ্গে রহস্যকে যোগ রাগ, ললিত রাগ, হেমন্ত রাগ দিয়ে বেঁধেছেন সৌগত। বৈদিক বাঁশি তুনাভ নালি, ভরতমুনি রচিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস নিয়ে সৌগত যে গভীর পড়াশোনা করেছেন তার প্রমাণ মেলে সিরিজ়ের প্রতিটি পরতে। আমির খসরু এবং আকবর আলি খাঁকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা সংকেত সূত্র হিসেবে ব্যবহার বহু মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করবে। এছাড়া সঙ্গীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার ও তাদের প্রাচীন নাম সবিস্তারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই সিরিজ়ে।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিক্রম সাবলীল। তবে কয়েকটি জায়গায় তাঁর অভিব্যক্তি একটু একমাত্রিক লাগে। চনমনে, ছটফটে শ্রুতির ভূমিকায় রূপসার অভিনয় ভালো। পরিণত বয়সের মধুমন্তীর চরিত্রে জয়তির অভিনয় আলাদা মাত্রা যোগ করে। কেদারনাথের চরিত্রে গাম্ভীর্য বজায় রেখেছেন রজত। বাকিরা প্রত্যেকেই নিজ চরিত্রে যথাযথ।
আরও পড়ুন: যন্তর মন্তর কক্ষের নেপথ্যে
তবে ‘তানসেনের তানপুরা’র সেরা প্রাপ্তি সঙ্গীত। গান সম্পর্কে যাদের সামান্য পড়াশোনা আছে, এই সিরিজ় তাঁদের কাছে বড় পাওনা। ভারতীয় মার্গসঙ্গীত যে শুধুমাত্র কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের ভালোলাগার জায়গা নয়, এই সিরিজ় দেখার পর দর্শক তা গভীরভাবে অনুধাবন করবেন। কাহিনীর চরিত্রের নামকরণও করা হয়েছে এক একটি রাগ রাগিণীর নামে যার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সংকেতের রহস্যও। জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যমে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেলেন জয় সরকার। তাঁকে যোগ্য সংগত করলেন জীমূত রায়, সোমলতা আচার্য, শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তুষার দত্ত, পিউ মুখোপাধ্যায়রা। পরিণত বয়সের মধুমন্তীর কণ্ঠে পিউ এবং আলাপের ক্ষেত্রে জীমূতের গান প্রশংসার দাবীদার। গানের কথা আমির খসরু ও শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
কোনও গোলাপই কন্টকবিহীন নয়। তাই ছন্দবদ্ধ ধাঁধার ব্যবহার যাতে একঘেয়ে না হয়ে যায়, পরবর্তী সিজ়নে সেটাই খেয়াল রাখতে হবে নির্মাতাদের।