যন্তর মন্তর কক্ষের নেপথ্যে

‘এই ঘরেই বুঝি লোকে রাজার বশ হয়?’

‘এই ঘর, যন্তর মন্তর।’

বন্ধ গবেষণাগারে দুজন সম্পূর্ণ অচেনা লোককে ঢুকতে দেখে ভয় পেলেও নিজের কীর্তির কথা জানাতে ভোলেননি গবুচন্দ্র জ্ঞানতীর্থ জ্ঞানাম্বুধি জ্ঞানচূড়ামণি গবেষক। নিজেই দেখিয়েছিলেন যন্তর মন্তর ঘরের খুঁটিনাটি। কোথায় মন্ত্র পুরে দিলে কীভাবে তা যন্ত্রের মুখ দিয়ে বেরোয়, যন্ত্রের কোন হাতলে কার মন্ত্র রাখা আছে, সব তিনি নিজেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন গুপী-বাঘাকে। কোনও হাতলে চাপ পড়লে বেরোবে ‘বাকি রাখা খাজনা মোটে ভালো কাজ না,’ তো কোনওটায় বেরোবে ‘ভর পেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই’। 



১৯৮০ সালে নির্মিত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’র ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে গুপী-বাঘা পৌঁছে যায় বৈজ্ঞানিকের আশ্চর্য গবেষণাগারে, যেখানে রয়েছে যন্তর মন্তর কক্ষ। কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই ঘর? গবেষণাগার যেমন হয় তেমনভাবেই এই ঘরকে সাজাতে হবে, এমনই নির্দেশ ছিল সত্যজিতের। এই সেট সাজিয়েছিলেন অশোক বসু। তাঁকে পরিষ্কারভাবে বলা ছিল এই ঘরে যেন কোনও কেরামতি না থাকে। স্কুল কলেজের ল্যাবরেটরি যেমন হয়, তেমনই হতে হবে গবেষকের ঘর। সেই নির্দেশেই ঘরে রাখা হয়েছিল বুনসেন বার্নার, বিকার, বকযন্ত্র বা রিটর্ট ও সিলিন্ডার, সাধারণ গবেষণাগারে যেমন থাকে। দেওয়ালে ঝোলানো হয়েছিল একটা কঙ্কাল এবং খাঁচায় রাখা ছিল বাদুড়, গিনিপিগ ও বাঁদর, অর্থাৎ যে কোনও সাধারণ ল্যাবরেটরির মতই।

শুধু দুটো জিনিস ছিল এই ল্যাবরেটরিতে নজর কাড়ার মতো। প্রথমটা সেই মেশিনগানের মতো বন্দুক, যার ট্রিগার টিপলে আগুন বেরোয়। কীভাবে তৈরী হয়েছিল এই বন্দুক? এরকম বন্দুক বিলিতি খেলনার দোকানে পাওয়া যেত। কিন্তু কলকাতায় তখন সেরকম দোকান কোথায়? অগত্যা বানিয়ে ফেলা হলো একটা আস্ত খেলনা বন্দুক। তারপর তার মধ্যে লাইটার প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হলো। অর্থাৎ ভেতরে থাকবে পেট্রল আর চকমকি পাথর। যার ঘর্ষণের ফলে বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসবে আগুন। খুব সাধারণ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যেটা তৈরি হলো সেটা সিনেমার পর্দায় দেখলে চমকে উঠতে হয়।

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

দ্বিতীয় ও অন্যতম অবাক করা জিনিস হলো মস্তিষ্ক প্রক্ষালক যন্ত্র। ‘এ এমন কল যাতে রাজকার্য হয়ে যায় জল। এর সাহায্যে, রাজভক্তি প্রকাশে নারাজ যে, তারে করে তোলা একনিষ্ঠ রাজভক্ত, মোটে নয় শক্ত।” এহেন ভয়ঙ্কর বিবরণ যে যন্ত্রের, তার রূপও তো তেমনই হতে হবে। যন্ত্রের ডিজ়াইন এঁকে দিলেন সত্যজিৎ। হাতে আঁকা সেই ছবি এমনই হয়েছিল যে দেখেই দর্শক ভয় পাবে। সেই ছবি দেখে তৈরি হলো দানবের মাথার মতো বিশালাকায় যন্ত্র। তার মুখের জায়গায় করা হলো একটা বিরাট গর্ত, অর্থাৎ ঘরে ঢোকার দরজা। মূল যন্ত্রের সঙ্গে যোগ ছিল উল্টোদিকে থাকা কন্ট্রোল প্যানেলের, যা দেখতে একেবারে ট্রেনের কেবিনরুমের মতো। সেই প্যানেলে ছিল ছ’টা হাতল। প্রতিটার থেকে একটা করে তার বেরিয়ে দেওয়ালে ঢুকে গেছে। আবার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে ঢুকেছে যন্ত্র দানবের মুখে। হাতলে চাপ পড়লে একটা ছোট্ট বিস্ফোরণের সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে কক্ষের দরজা। তারপর একটা আলোর ফ্ল্যাশের সঙ্গে শুরু হবে মন্ত্রপাঠ। সেই জলদগম্ভীর যান্ত্রিক কন্ঠস্বর ছিল স্বয়ং সত্যজিতেরই।

এই সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোনওরকম ক্যামেরার কারসাজি ছিল না। সবটাই করা হয়েছিল খুব সহজ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে, আজকের দিনে যে জিনিস করতে গেলে হয়তো ভিএফএক্সের সাহায্য নেওয়া হতো। আজ থেকে ৪০ বছর আগে সে জিনিস তৈরি হয়েছিল খুব সহজ পদ্ধতিতে, আর তাই দেখে তাক লেগে গিয়েছিল আট থেকে আশি সব বয়সের দর্শকের। এই আজব যন্ত্রের মন্ত্রপাঠের সাহায্যেই শ্রমিক ও কৃষকের মগজ ধোলাই হয়েছিল। হতে পারত শিক্ষক ও ছাত্রদেরও। কিন্তু হীরকের অর্থানুকুল্যে তৈরি যন্ত্রে শেষমেশ ঢুকতে হলো নীচ, ক্রুর, খল সেই রাজাকেই।

তথ্যসূত্র: টেলিভিশন, জুন ১৯৯২

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *