পরিকল্পনাহীন চিন্তাভাবনা অবিলম্বে ত্যাগ করুন
পূজা শরাফ: সম্প্রতি এক তরুণ অভিনেতার আত্মহত্যা আচমকাই আমাদের অজস্র প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য করেছে। সাফল্যের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েও নিজেকে শেষ করে দেওয়া অনেকের কাছেই এখনও অবিশ্বাস্য লাগছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে যে আমরা যতটা গুরুত্ব দিয়ে শারীরিক অসুস্থতার কথা ভাবি, মানসিক সমস্যাতেও কি একইভাবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন? পরিস্থিতি জানার পর আমাদের মনে সন্দেহ জাগছে যারা নতুন কাজ করছেন, প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে দৌড়চ্ছেন তাঁরা কি নানাভাবে তাঁদের ওপর হয়ে চলা শোষণের সঙ্গে আপোষ করে চলছেন? হয়তো তাই। কিন্তু শুধুই কি অভিনয়ের জগতে চলে এই মাৎস্যন্যায়? উত্তর সম্ভবত না। সমাজের সমস্ত স্তরেই ক্রমাগত বেড়ে চলা চাপের কারণে এক শ্রেণীর কর্মীরা নিজেদের অবহেলিত ও শোষিত বলে মনে করেন। চিরকাল এমনটাই হয়ে আসছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। কাজের জায়গায় এই প্রবল পরিমাণ চাপের ফলস্বরূপ বেড়ে চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা।
অস্থায়ী চাকুরীজীবিরা বা যাঁরা ফ্রিল্যান্সিং করেন বা বিভিন্ন ধারার শিল্পীরা অনেক সময়েই অনিশ্চিত আয়ের কারণে অবসাদে ভোগেন। এক্ষেত্রে পরবর্তী কাজ বা প্রাপ্য চেক আসবে কিনা সেই নিয়ে এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ও মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় অধিকাংশ কর্মীকেই। ফলে দৈনন্দিন জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা। মানসিক উদ্বেগ বাড়তে-বাড়তে মনের কোণে উঁকি দিতে থাকে নানা কল্পিত পরিস্থিতি। ‘যদি আর কাজ না পাই’, ‘যদি অর্থাভাব দেখা দেয়’, ‘যদি দেউলিয়া হয়ে যাই’, ‘যদি মাথার ওপর ছাদ না থাকে’, ‘যদি কোনওভাবে শেষ আশ্রয়টুকুও চলে যায়’, এমন নানা প্রশ্ন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করতে থাকে। নানা ধরণের নেতিবাচক চিন্তা বারবার ফিরে এসে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নিজের যোগ্যতা নিয়েই তখন সন্দেহ জাগতে থাকে। হারিয়ে যায় নিজের প্রতি আস্থা। নিজের ক্ষমতায় এগিয়ে চলার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না।
এই অবস্থায় সবচেয়ে আগে যেটা দরকার সেটা হলো নিজেকে বিপন্নরূপে শনাক্ত করা। সাধারণত এই অবস্থায় অবসন্নতা এসে গ্রাস করে, কোনও কাজেই উৎসাহ পাওয়া যায় না। তবে এর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও প্রাথমিকভাবে নিজেকেই করতে হবে। এই ধরণের নেতিবাচক চিন্তা থেকে মনকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ চিন্তা নিশ্চয়ই উপকারী, কারণ তা আগামী দিনের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। কিন্তু যে চিন্তার মধ্যে গঠনমূলক কোনও পরিকল্পনা থাকে না তাকে অবিলম্বে ত্যাগ করা প্রয়োজন। কোন পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন এবং কোনটি নয়, এই দুই অবস্থার মধ্যে তুলনা করে কর্তব্য স্থির করা প্রয়োজন। যেমন আপনি কাজ পাবেন কিনা তা আপনার নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও নতুন কাজ খোঁজা কিন্তু আপনার ক্ষমতার মধ্যেই পড়ে। একসঙ্গে অগুনতি বিষয়ে দুশ্চিন্তা না করে যে কোনও একটি চিন্তায় মনোনিবেশ করলেই একমাত্র তার সমাধান করা যেতে পারে। অনেকটা চাকরীর আবেদন করার মতো যার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
গতানুগতিক পন্থার বাইরে গিয়ে চিন্তা করলে অনেক সময় ফল পাওয়া যায়। যেমন অর্থাভাবের সময় অযথা হতাশ না হয়ে খরচ কমিয়ে বা কারোর থেকে ঋণ নিয়ে সাময়িকভাবে অবস্থা সামাল দেওয়া যেতে পারে। যে কোনও বিপদের সময় সবরকম সম্ভাবনার কথা আগে ভেবে রাখা দরকার। তারপর প্রতিটা সম্ভাবনার সুবিধা অসুবিধা বিচার করে তবে সিদ্ধান্তে আসা উচিত। প্রয়োজনে এমন কারোর পরামর্শ নেওয়া দরকার যিনি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমস্যার সমাধানে সহায়তা করতে পারেন। এর সঙ্গেই সমস্যার মধ্যে থেকেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম ও খাওয়ার দিকে নজর দেওয়া উচিত।
সামাজিকতা রক্ষার্থে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টাটুকু চালিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ আহারনিদ্রা ত্যাগ করে সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। মানসিক চাপ নিতে পারার জন্য শরীরকে সুস্থ রাখা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তবে আপনি যদি একজন অন্তর্মুখী মানুষ হন এবং নিজের সম্পর্কে অন্যকে অবহিত করতে অভ্যস্ত না হন সেক্ষেত্রে কোনও থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এমন কেউ যিনি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য যার কাছে সুরক্ষিত থাকবে, এমন বিশেষজ্ঞর কাছে গেলে তিনিই আপনাকে মানসিক সমস্যা থেকে উদ্ধারের উপায় বাতলে দেবেন। যেহেতু তিনি আগে থেকে আপনাকে বা আপনার পারিপার্শ্বিককে জানেন না, তাই তাঁর সামনে মনের কথা বলা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। তিনিও নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতির বিচার করে পরামর্শ দানে সক্ষম হন।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
এখন প্রশ্ন হলো, কোনও ব্যক্তি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছেন তা কীভাবে বোঝা যাবে বা তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন এ কথাই বা কী করে জানা সম্ভব? এক্ষেত্রে বলা যায় কোন ব্যক্তি অতিমাত্রায় অবসাদে ভোগেন বা তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন তা বুঝতে গেলে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলির কয়েকটি অন্তত মিলছে কিনা তা দেখা যেতে পারে
- নিরাশ অনুভব করা
- নিজেকে অপছন্দ করা বা ঘৃণা করতে শুরু করা
- নিজের কোনও মূল্য নেই বা অন্যের উপরে নিজেকে বোঝাস্বরূপ মনে করা
- কাজেকর্মে উৎসাহ হারানো
- অনেকদিন ধরে একটানা অবসাদগ্রস্ত থাকা যেখানে কোনও কিছুই আর আনন্দ দিতে পারে না
- মাঝেমধ্যে খুব সামান্য কারণে কান্নাকাটি করা
- খিটখিটে মেজাজ
- অন্যদের থেকে নিজেকে পৃথক করে নেওয়া
- ঘুম বা খাওয়ার রুচি হারানো, অথবা অতিরিক্ত ঘুমানো ও স্বাভাবিকের থেকে বেশি খাওয়া
- বিরক্ত ও ক্লান্ত অনুভব করা
- সাধারণত করেন না এমন আচরণ করা, যেমন কয়েকদিন ধরে স্নান না করা বা পরিচ্ছন্ন না থাকা
- নিজেকে আঘাত করা, অতিরিক্ত মদ্যপান বা অন্য কোন মাদক গ্রহণের মত আত্ম-ধ্বংসী আচরণ বৃদ্ধি পাওয়া, এবং
- ভবিষ্যত সম্পর্কিত দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা করতে না পারা
এছাড়াও কিছু জটিল ও জরুরী পরিস্থিতির লক্ষণ দেখা যেতে পারে যা এরকম:
- অন্যেরা দেখতে পাচ্ছে না এমন জিনিস শুনতে বা দেখতে পাওয়া, বিশেষ করে যদি সেই সকল চিন্তাসমূহ যা নিজেকে আঘাত করতে বলে
- ‘বেঁচে থাকার কোনও মূল্য নেই; কোনওদিনই এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না; আমি এর থেকে নিস্তার পেতে চাই; এর চেয়ে মৃত্যু আরো সহজ হবে’ এইপ্রকার চিন্তাভাবনা করা
- সময়, স্থান ও কৌশলের মত নিজের মৃত্যু সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনা করা
- জমে থাকা কাজকর্মের সুরাহা করা, বিদায় জানানো, আত্মহত্যার জন্য অনুশীলন করার মত চিন্তাভাবনাসমূহ।
যদি আত্মহত্যার প্রবণতা অনুভব করেন, তবে একজন পেশাদারের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের জন্য হেল্পলাইনে যোগাযোগ করে সঠিক পরামর্শ পেতে পারেন। ভারতে শহর অনুযায়ী এ সংক্রান্ত হেল্পলাইনে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আপনার অবিলম্বে মনোবিদের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। যে কোন অসুখে আমরা যেভাবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবার চেষ্টা করি এক্ষেত্রেও সেই একই পদ্ধতিতে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। আত্ম্যহত্যাপ্রবণতা এক ধরণের অসুখ, অন্যান্য সব রোগের মতো সমান গুরত্ব সহকারে চিকিৎসার করলে এই রোগ নিরাময় হওয়া সম্ভব।
লেখক ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত
ছবি প্রতীকি