মন নিয়ে (পর্ব ২): মধ্যবিত্তের লাইফস্টাইল সমস্যার সমাধানের খোঁজে অনুত্তমা
নাগরিক সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সাধারণ মানুষের মানসিক সমস্যাও। কেবল সমাজের উঁচুতলার মানুষই মানসিক সমস্যার শিকার, এই ধরণাটা এখন আর চলে না। প্রথম পর্বে সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভরতা থেকে ছাত্রছাত্রীদের হতাশা ও অবসাদ নিয়ে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন বিশিষ্ট মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় ও অন্তিম পর্বে তিনি জানালেন ছেলেমেয়েদের ওপর বাবা মায়ের কতটা কর্তৃত্ব রাখা উচিত ও বৃদ্ধ বয়সের একাকীত্ব কী ভাবে দূর করা যায়।
বাবা মায়ের, বিশেষ করে মায়েদের অতিরিক্ত আগলে রাখার ফলে ছেলেমেয়েরা পরিণতমনস্ক হতে পারছে না বলা হয়। কিন্তু জেনারেশন গ্যাপ তো অবশ্যম্ভাবী। তাহলে কোনটা করা দরকার, ছেলেমেয়েদের বন্ধু হয়ে যাওয়া নাকি আগেকার দিনের মতো কড়া শাসনে রাখা?
অনেকেই আছেন যাঁরা দিনরাত উঠতে বসতে বাচ্চাকে শোনান ‘তোর জন্য আমি এত স্যাক্রিফাইস করলাম, তুই আমার জন্য কি করলি?’ এরপরে একদিন কিন্তু সেই বাচ্চাটাই বড় হয়ে বলবে, ‘কে বলেছিল তোমাকে আমার জন্য চাকরি ছাড়তে?’ সুতরাং এই অস্বাস্থ্যকর আলোচনাকে বাদ দিয়ে বাচ্চাটির সঙ্গে যতটুকু সময় কাটাচ্ছেন সেই সময়টায় তার সঙ্গে গল্প করুন। যদি সেই সময়টায় শুধুই তাকে জেরা করে যান যে তার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, বা নম্বর এত খারাপ হচ্ছে কেন, বা তাকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে কিন্তু সে কখনওই তার বাবা মাকে আপন ভাবতে পারবে না। আপনি তার কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠবেন। বাচ্চাকে তার আবেগের জায়গায় ছুঁতে হবে। বন্ধু হয়ে যাওয়া নয়, বাবা মা অবশ্যই তাঁদের নিজের জায়গাতেই থাকবেন। কিন্তু এমন একটা জায়গা তৈরি করতে হবে যেখানে বাচ্চাটি বুঝতে পারবে তার রাগের কারণ বা মনখারাপের কথাটা মাকে বা বাবাকে বলা যায়। শাসন নিশ্চয়ই দরকার, কিন্তু অতিরিক্ত শাসন সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেয়।
কোথাও গিয়ে কি সমসাময়িক লাইফস্টাইলের চাপও বাচ্চাদের হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে না? সমবয়সী অন্যদের এক ধরণের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে দেখে সদ্য বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের তো মনে হতেই পারে, ও যদি এটা করতে পারে তাহলে আমি পারব না কেন?
সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় কিছুটা স্বাধীনতা ছেলেমেয়েদের দেওয়া দরকার। যেটা ওদের সময়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক আচরণ, সেটাকে অস্বীকার করে ‘আমাদের সময়ে এটা হতো না’ বলে তাকে বাধা দেওয়াটা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আপনি একজনকে কালার টিভির সামনে বসিয়ে তাকে এটা বলতে পারেন না যে আমাদের সময়ে আমরা সাদাকালোতে দেখতাম, তাই তোমাকেও তাই দেখতে হবে। আমরা তো শুরুটাই করি না বোঝা দিয়ে, তাই ওরা আমাদের আর কাছের মানুষ ভাবতে পারে না। কথা শুরু করার আগেই জানে যে এরা বুঝবে না। তাই আগেই তাকে বারণ না করে আমার দুশ্চিন্তার কারণটা তাকে বোঝানো দরকার। এটা বোঝানো দরকার, তুমি যে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খেতে যাবে বলছো, সেই জায়গাটা তেমন ভালো নয়, তোমার নিরাপত্তার কারণে আমি চিন্তিত। এটা কখনওই বলা উচিত নয় যে আমি ক্লাস এইটে একা কোথাও যেতাম না বলে তুমিও যাবে না। এটা নির্বোধের মতো কথা। আমার সময় আর তার সময়টা তো এক নয়, সেটা মেনে নিতে হবে। তাই তাকে এটা বোঝাতে হবে, কোনওরকম সমস্যা হলে সে যেন অবশ্যই জানায় বা যোগাযোগ করে। তারা যখন রাতে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে বা খেতে যাচ্ছে, তখন দু’ একজন বন্ধুর ফোন নম্বরও নিয়ে রাখা দরকার। তাই বলে তাকে প্রতি দশ মিনিট অন্তর ফোন করে বিরক্ত করলে ভবিষ্যতে সে কিন্তু আর জানাবেও না কোথায় যাচ্ছে। আজকাল ছেলেমেয়েরা বন্ধুদের সঙ্গে ডিস্কে যায়, হয়তো ড্রিংকস করে, সেটা হয়তো নাও বলতে পারে বাড়িতে। তাই তাকে এটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে যেখানে যাচ্ছ যাও, কিন্তু এমন কোনও আচরণ করবে না যাতে থানা থেকে আমাকে ফোন পেতে হয় বা তোমার কোনও বন্ধু ড্রিংক করে থাকলে তার গাড়িতে তুমি উঠবে না।
কিন্তু এত কিছু করেও সবসময় শেষরক্ষা হয় কি?
সেটা হয়তো একদিনে সম্ভবও নয়। ছোট থেকে যদি তাকে বোঝানো যায় যে আমি তোমার জন্য চিন্তিত, তোমার খারাপ কিছু হলে আমার কষ্ট হয়, সারাক্ষণ শাসন না করে যদি তাকে আবেগের জায়গায় ছোঁয়া যায়, অনুশাসনের মধ্যে রাখা হয়, তাহলে সেও কিন্তু অবাধ্য হওয়ার আগে ভাববে। তাই তাকে কারণটা বুঝিয়ে বলা দরকার, অকারণে বকাঝকা করলে কোনও ফল হয় না। বরং তাকে এটা বলা দরকার যে তুমি বড় হয়েছ, তাই যা করবে দায়িত্ব নিয়ে করবে। দায়িত্ব নিতে শেখালে সে ভুল করার আগে ভেবে দেখবে।
আরও পড়ুন: আবারও বড় পর্দায় প্রজ্ঞাপারমিতা বনাম ব্যোমকেশ
বয়স্ক মানুষদের একাকীত্ব সমসময়ই একটা সমস্যা ছিল। বিশেষ করে এদেশে এই সমস্যাটা প্রকট, এবং এই ক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকাটাকে খুব খারাপ চোখে দেখা হয়। বিদেশের ছবিটা কেমন? কোথাও কি মনে হয় এই অবস্থাটা পাল্টানো দরকার?
বিদেশে তো ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের সঙ্গে থাকেই না। সেখানে নিয়মই হলো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলেই ছেলেমেয়েরা আলাদা হয়ে যাবে। সেখানে বরং একসঙ্গে থাকাটাই অস্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। আমি বলব, বৃদ্ধাশ্রমে কেউ যাবেন কি না সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কেউ চাইলে যেতেই পারেন, আবার কেউ বলতে পারেন আমি কেন আমার বাড়ি ছেড়ে যাব? দুটো সিদ্ধান্তই সঠিক। তাই তাঁদের সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে নেওয়াটা জরুরি। এমন তো হতেই পারে কারোর সন্তান বিদেশে থাকেন। তাঁর পক্ষে বাবা বা মাকে সবসময় দেখা বা সঙ্গ দেওয়া সম্ভব নয়। সেইসব ক্ষেত্রে তাঁদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে না রেখে এমন কোথাও রেখে আসা যায় যেখানে তাঁরা তাদের সমবয়সী ও সমমনস্ক মানুষ পাবেন, এবং ভালো থাকবেন। এটা তো খারাপ কিছু নয়। সত্যিই কিন্তু তাঁরা ভালো থাকেন। তবে সেটা যদি একান্তই না করা যায় তাহলে তার কাছে আয়া রেখে বা হোম কেয়ারের ব্যবস্থা করে তাঁদের দেখাশোনা করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে অনেক মানুষই বেশি বয়সে অর্থকষ্টে ভোগেন। কারোর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আর্থিক দিক থেকে স্বাধীনভাবে জীবন কাটাতে পারেন না। এটাও তো একটা সমস্যা
অবশ্যই। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা বা চাকরির খাতে অনেকেই তাঁদের জীবনের বেশিরভাগ সঞ্চয় খরচ করে ফেলেন। ফলে বেশি বয়সে গিয়ে যে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয় সেটা তাকে কোথাওই শান্তি দেয় না। এই সঞ্চয়টা ঠিকভাবে করতে পারলে বৃদ্ধ বয়সে কোনও রিটায়রমেন্ট হোমে গিয়ে কিন্তু অনেক আরামে জীবন কাটানো যায়। অনেকেই কিন্তু এখন চাইছেন যে শেষ বয়সটা এরকম কোথাও আরামে কাটুক। সেক্ষেত্রে দরকার ভালো মানের একটা বৃদ্ধাশ্রম যেখানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের পাশাপাশি ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থাও থাকবে। এ দেশে বৃদ্ধাশ্রমের নামেই যে একটা আতঙ্ক রয়েছে সেটা কাটানো দরকার। তাই শুরু থেকেই সন্তানকে বড় করতে গিয়ে সমস্ত সঞ্চয় খরচ না করে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য ব্যবস্থা করে রাখা দরকার যাতে কোনভাবেই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে না হয় এবং বৃদ্ধ বয়সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া যায়।
এই সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন