“প্রথমবার প্রস্তাব শুনে ‘অসম্ভব’ বলেছিলেন সৌমিত্র”

২০২০ সালে তাঁর গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘শ্রাবণের ধারা’। গল্প হলেও সে ছিল তাঁর দীর্ঘ ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। কর্মসূত্রে নিউ জার্সির বাসিন্দা হলেও সেই ছবির সূত্রেই কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছাকাছি আসেন শুভেন্দু সেন। ক্রমশ সেই পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা থেকে গড়ে ওঠে সৌমিত্রের জীবনের কাহিনী নিয়ে ছবি ‘অভিযান’। কীভাবে সম্ভব হলো সেই আপাত অসাধ্য কাজ? জানালেন শুভেন্দু, শুনল রেডিওবাংলানেট

“আলাপ হওয়ার পর সৌমিত্র আমাকে ওঁর লেখা ‘গদ্য সংগ্রহ’ বইয়ের দুটি খন্ড পড়তে দেন। বইগুলো পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সৌমিত্র মানেই আমরা জানি এক বিশাল মাপের অভিনেতা। অথচ কী গভীরতা মানুষটার লেখার মধ্যে। আমি ওঁর গল্পগুলো অনুবাদ করতে চেয়েছিলাম। উনি রাজি হয়েছিলেন। ওই বইয়ের সূত্রেই মাঝেমধ্যে আমাদের কথা হতো। কখনও ঈশ্বর নিয়ে আবার কখনও মৃত্যু বা অবসাদ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম আমরা। সেই আলোচনায় কখনও সিনেমা বা অভিনয় আসত না। শুধুই জীবনের আলোচনা হতো। এরকম বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন আমার মনে হলো ওঁর জীবনের গল্প নিয়েই তো একটা ছবি হতে পারে। প্রথমবার প্রস্তাব শুনেই বললেন, অসম্ভব, এ হতে পারে না। আমি আবারও অনুরোধ করতে উনি বললেন, তুমি ‘বেন হার’ ছবিটা দেখছ? ওখানে কিন্তু কোথাও যীশুকে দেখায়নি। পিছন থেকে তাঁর কাঁধ বা তাঁর সোনালী চুল দেখিয়েছে। কিন্তু কখনও সামনে থেকে দেখায়নি। কীভাবে দেখাবে, কে করবে ওই চরিত্র? সেরকমই ছবিতে আমার প্রতিনিধিত্ব করার মতো কাকে পাবে তুমি?” বললেন শুভেন্দু। 

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

“আমি বলেছিলাম,” শুভেন্দু বললেন, “এটা যদি করা যায় তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা রেকর্ড তো থাকবে। আপনার মুখ থেকেই আপনার সম্পর্কে জানতে পারবে দর্শক। শুনে বললেন, ডাক্তার হয়েও আমার বয়সটার ওপর ভরসা করতে পারছ না নাকি? তারপর হঠাৎ একদিন দুপুরে নিজেই বললেন, কীভাবে কাজটা করবে ভেবেছ? তখন আমি পরিচালনার ব্যাপারে পরমব্রতর (চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে কথা বলি। ওর নিজেরও এই ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। এইসব ঘটনা ২০১৮ সালের। ছবির প্রথম চিত্রনাট্যটা পরমব্রত চেয়েছিল আমি করি। আমিই করেছিলাম। পরবর্তী চিত্রনাট্যটা লেখে পরম ও আমার বিশিষ্ট বন্ধু পদ্মনাভ (দাশগুপ্ত)।” 

ছবিতেও তাঁর মতোই একজন ডাক্তার থাকবেন যিনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। এই চরিত্রে অভিনয় করছেন পরমব্রত। তবে ‘অভিযান’-এ শুধুমাত্র সৌমিত্রর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাই দেখানো হবে বলে জানালেন শুভেন্দু। 

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

ছবিতে কাকে দেখবে দর্শক? অভিনেতা, না মানুষ সৌমিত্র? 

“মানুষ সৌমিত্রই বেশি করে উঠে আসবেন এ ছবিতে,” জানালেন শুভেন্দু। “বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁর অনুভূতির কথা জানব আমরা। অনেক অজানা কথা উনি আমাকে বলতেন। হয়ত এই কারণেই বলতেন কারণ আমি সেগুলো কখনও জানতে চাইতাম না। আমি কোনওদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করিনি ফেলুদা করতে গিয়ে ওই দৃশ্যটা উনি কীভাবে করেছেন,  বা অমুক চরিত্রের কোন  বিশেষ দিকটা ওঁর ভালো লেগেছিল। আমি মানুষ সৌমিত্রকেই জানতে চেয়েছিলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা কথা বলতাম। এক একদিন প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টা ধরে। সেসব কথা উনি আমাকে রেকর্ড করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তার মধ্যে থেকেই কিছু অংশ ছবিতেও থাকবে, সেগুলো তাঁর অনুমতি নিয়েই রাখা হয়েছে।” 



কী-কী বিষয়ে কথা বলতে ভালোবাসতেন সৌমিত্র? 

“নিজেকে অজ্ঞাতবাদে বিশ্বাসী বলতেই পছন্দ করতেন উনি। সকলেই জানেন সৌমিত্র বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ছিলেন। অথচ বিরুদ্ধ মত পোষণ করেন এমন বিখ্যাত নেতাদের জীবনী বা লেখাও তিনি আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন। এমনকি ওঁর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে মেলে না এমন ব্যক্তিত্বের কোনও গুণ দেখলে সেটা বারবার বলতেন। সবার মধ্যে থেকে ভালোটুকু বার করে নিতে জানতেন। বলতেন, আমাকে কোনও কোণে ফেলে দিলেও সেই ধুলো থেকে আমি জীবন বার করে নেব। এরকমই ছিলেন উনি, নানা বিষয়ে অদম্য কৌতূহল ছিল। এমনও হয়েছে, আমরা কোনও গভীর বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, কলকাতার এক নামি পরিচালক এসেছেন দেখা করতে। তাকে বলে দিলেন, এখন আমি ব্যস্ত আছি, পরে এস।”

আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ

এতকিছুর পরেও যাকে ঘিরে এই কর্মকাণ্ড তিনি ছবিটা দেখে যেতে পারলেন না বলে শুভেন্দুর আফসোস। “একদিন বলেছিলেন, আমার মৃত্যুভয় নেই। তারপরেই বললেন, ঠিক সত্যি বললাম না কথাটা। আমি চাই যেন স্টেজে অভিনয় করতে-করতে চলে যেতে পারি। কতরকম কথা যে বলতেন আমাকে। পরমব্রতকে বলেছিলেন, ছবিটা করার সময় ডঃ সেনকে সঙ্গে রেখো, উনি অনেক কিছু জানেন,” স্মৃতি হাতড়ে বললেন শুভেন্দু।

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

তাঁর বলা এই অজস্র অজানা কথার সবটা তো এই ছবিতে থাকছে না। সেই বাকি অংশকে নিয়ে কী ভাবছেন তিনি?

“এই আলোচনাগুলোর নানা কথা নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখার ইচ্ছে রয়েছে আমার আগামী বইতে,” জানালেন শুভেন্দু। “হয়ত সেই বইয়ের নাম হবে ‘সৌমিত্র: ইন এ ডিফারেন্ট অ্যাঙ্গল’ বা অন্য কিছু। আপাতত তিনি যতটুকু দর্শকদের জানাতে চেয়েছেন সেটুকু নিয়েই আসছে ‘অভিযান’।”

১৪ এপ্রিল মুক্তি পেতে চলেছে ছবিটি। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *