শাহরুখেই বাজিমাত, অন্য প্রাপ্তিও কম নয়

ছবি: জওয়ান

অভিনয়ে: শাহরুখ খান, নয়নতারা, বিজয় সেতুপতি, দীপিকা পাডুকোন, সুনীল গ্রোভার, প্রিয়ামণি, সানিয়া মালহোত্র, ঋদ্ধি ডগরা, সঞ্জীতা ভট্টাচার্য

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট

পরিচালনা: অ্যাটলি কুমার

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক যাদের হাফপ্যান্ট বা ফ্রক পরে কেটেছে, শাহরুখ খান তাদের কাছে এক জাদুকর। সেই সময়ের তারা কেবল জুলুজুলু চোখে টেলিভিশনের পর্দাতেই তাঁকে দেখতে পেত। শুনতে পেত, ‘শারুপ খান’-এর ‘বই’ বেরোলে নাকি বড়রা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবিতে মালা পরায়, হলের মধ্যে নাচানাচি করে। তারাও আশা রাখত, একদিন সেই উন্মাদনায় অংশগ্রহণ করবে। যখন তারা বড় হলো, তখন শাহরুখ-সূর্য অনেকটাই ঢলে পড়েছে। একের পর এক বড় ব্যানারের ছবি মুখ থুবড়ে পড়ছে। হতাশ হলেও তারা আশাহত হতো না। মনে-মনে জানত, ‘গুরু’ ফিরবেই! তিনি ফিরলেন, এবং কীভাবে! মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রথমে ‘পাঠান’, আর এখন ‘জওয়ান’ বক্স অফিসের নিরিখে সর্বকালের সফলতম ভারতীয় ছবি হওয়ার পথে।



‘জওয়ান’-এর শুরু এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে কয়েক ঘর নেপালি মানুষের বাস। একদিন তারা জলে একটি লোককে ভেসে যেতে দেখে তাকে তুলে আনে। লোকটির শরীরে প্রাণ আছে দেখে তারা তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করে। এর কিছুদিন পর গ্রামে হঠাৎ নেমে আসে এক বিপত্তি। আচমকাই হানা দেয় কয়েকজন ডাকাত, চলতে থাকে লুঠতরাজ ও যথেচ্ছ খুনোখুনি। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামবাসীরা তাদের দেবতাকে স্মরণ করতে থাকে। এমন সময় উপস্থিত হয় শমনরূপী সেই অসুস্থ মানুষটি, অর্থাৎ শাহরুখ। শত্রুনিধন শেষে তার মুখ থেকে একটাই প্রশ্ন আসে, সে কে?

আরও পড়ুন: ডিসেম্বরেই সৌরভের ভূমিকায় আয়ুষ্মান

কাহিনি এগিয়ে যায় তিন দশক। মুম্বইয়ের একটি মেট্রো রেক হাইজ্যাক করে শাহরুখ ও তার দলবল (প্রিয়ামণি, ঋদ্ধি, সঞ্জীতা, সানিয়ারা)। সেই হাইজ্যাক ঠেকাতেই বিশেষ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার নর্মদার (নয়নতারা) ডাক পড়ে। সঙ্গে তার সহকারী ইরানি (সুনীল)। রহস্যময় এই হাইজ্যাকারের সঙ্গে কথা বলে তার দাবি জানতে পেরে নর্মদার চোখ কপালে উঠে যায়। এমন দাবিও কি সম্ভব! এদিকে সেই মেট্রোয় উপস্থিত বিখ্যাত ব্যবসায়ী কালীর (বিজয়) মেয়ে। তার গায়ে যেন একটি আঁচড়ও না লাগে, সেই শর্তে কালী সরকারকে সাহায্য করে। দাবি মিটে যেতেই যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায় এই দল। প্রশ্ন ওঠে, এরা কারা?

শাহরুখেই বাজিমাত

বিপুল তারকাখচিত ছবি হলেও, ‘জওয়ান’-এর প্রধান আকর্ষণ শাহরুখ। ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় থাকা বিজয় তাঁর চিরাচরিত অভিনয়ের মাধ্যমে যথাযত সঙ্গত দিয়ে গিয়েছেন। নায়িকার ভূমিকায় নয়নতারার উপস্থিতি উজ্জ্বল। তাঁর অংশটুকু তিনি সযত্নে পালন করেছেন। এদিকে দীপিকার স্বল্প সময়ের উপস্থিতিতেই পর্দায় তাঁর গুরুত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। বাকিদের মধ্যে সুনীল, প্রিয়ামণি, সানিয়া ও সঞ্জীতা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

আরও পড়ুন: সাধারণ দর্শককে ছুঁতে না পারলে ছবি করে লাভ নেই, মনে করেন রুদ্রনীল

মশলাদার অ্যাকশন ছবিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার আবহসঙ্গীত। পরিচালক যোগ্য হাতেই সে দায়ভার ন্যস্ত করেছিলেন। সঙ্গীত পরিচালক অনিরুদ্ধ রবিচন্দ্র দক্ষিণী ছবিতে আবহসঞ্চারে সিদ্ধহস্ত। এ ছবিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ছবি দেখে বেরোনোর অনেকক্ষণ পরেও মাথার মধ্যে থাকে সে রণ-আস্ফালনের সুর।

পরিচালনার পাশাপাশি ছবির কাহিনিকারও অ্যাটলি। কাহিনিতে নতুন কিছু নেই। এর আগে বহুবার একই প্লটে একাধিক ছবি হয়েছে। তবু পাচকের গুণে সে কথা চট করে মাথায় আসবে না। উল্টে এত দ্রুতগতির ছবিতে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যায় না।

সুমিত অরোরার লেখা সংলাপও এমন ছবির জন্য উপযুক্ত। সে সংলাপের বেশিরভাগটাই খোদ নায়কের মুখে উচ্চারিত হয়। আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক কিছু সংলাপ এমনভাবে দর্শকের মনে বিঁধে যায় যে তা শেষ হওয়ার পর প্রশংসাসূচক হাততালিতে প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়ে।



ছবির চিত্রগ্রাহক জিকে বিষ্ণুর কাজ বিশেষ প্রশংসাযোগ্য। বিশেষ করে দরিদ্র সমাজব্যবস্থার বর্তমান রূপ তুলে ধরতে ক্যামেরার কাজে তিনি যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। অ্যান্টনি রুবেনের সম্পাদনাও যথাযথ।

এরপরেও কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়। এতজন দক্ষ অভিনেতা থাকার পরেও তাঁদের পর্দায় উপস্থিতি এবং সঙ্গত খুবই কম। বিজয় খলনায়ক হওয়ার খাতিরে তাও কিছুটা জায়গা পেয়েছেন। ছবির দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় পুরোটাই শাহরুখ। প্রথমার্ধ যতটা সুন্দর লয়ে বাঁধা হয়েছিল, দ্বিতীয়ার্ধে বেশি অ্যাকশন দৃশ্য আনতে গিয়ে তা যেন বড্ড হুড়মুড়িয়ে শেষ হয়ে গেল। কিছু চরিত্রের চিত্রায়নে বিদেশি ছবির প্রভাব স্পষ্ট। শাহরুখের প্রথম আবির্ভাবের রূপ দেখে মার্ভেলের মুন-নাইটের কথা তো ছবির মোশন পোস্টার মুক্তি পাওয়ার সময় থেকেই চর্চায় ছিল। এই ছবিতে মিঃ ডি নামে এক চরিত্রকে দেখা যায়। যাকে দেখলে ব্যাটম্যান সিরিজ়ের খলনায়ক বেনের কথা মনে পড়তে পারে।

আরও পড়ুন: কালিম্পংয়ে হত্যারহস্যে রঞ্জিত, পার্নো, ঋত্বিক

তবে সুখবর একটাই, ‘জওয়ান’-এর নির্মাতারা যদি ব্যাপক সাফল্যের কথা অনুমান করেও থাকেন, তাঁরা ছবির শেষে এমন কোনও উপাদান রাখেননি, যা থেকে সিক্যুয়েল তৈরি হতে পারে। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি বলতে যা বোঝায়, তাতে ঘটনার ঘনঘটা থাকলেও যুক্তি খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হয়। এই ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। একসময় সিলভেস্টর স্ট্যালন বা আর্নল্ড শোয়ারজ়েনেগরকে দেখতেই দর্শক হল ভরাত। সেই সব ছবিতে গল্প বা যুক্তি ছিল গৌণ।

তাই শাহরুখেই বাজিমাত ‘জওয়ান’। প্রায় তিন ঘণ্টার ছবিতে মুহুর্মুহু উল্লাসের রোল উঠল, সিটি বাজল। মাল্টিপ্লেক্স হোক বা সিঙ্গল স্ক্রিন, এমন দৃশ্য শেষ কবে কোন প্রেক্ষাগৃহে দেখা গেছে মনে পড়ে না। এ প্রাপ্তিই বা কম কী!




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *