ছাপা অক্ষরের উপন্যাসটা তো কেউ আর পাল্টে দিতে পারবে না: স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

তার লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে বিরসা দাশগুপ্তর ছবি ক্রিসক্রস মুক্তি পেয়েছে গত শুক্রবার। এরই মাঝে অনেক চেষ্টা করে পাকড়াও করা গেল সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী-কে। অফিসের ব্যস্ততার মধ্যেও একান্ত সাক্ষাৎকারে রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন ছবিতে গল্পের বদল নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া ও নিজের লেখালেখির কথা।

ক্রিসক্রস দিয়েই শুরু করা যাক। ছবিটা দেখেছ?

না, এখনও সময় করে উঠতে পারিনি।

উপন্যাসটা যেভাবে লেখা, আর ছবিটা যেমন বানানো হয়েছে, দুটোর মধ্যে কোনও মিল নেই। তুমি নিজে এটা শুরু থেকে জানতে?

উপন্যাসের চিত্রসত্ত্ব কেনার পর ওরা আমাকে জানায় যে ছবিটা মেয়েদের ওপর ফোকাস করে বানাতে চায়। পুরুষ চরিত্রের যে ক্রাইসিসগুলো আছে সেগুলোকে মেয়েদের চরিত্রে দেখাতে চায়। ওরা গল্পটাকে নিজেদের মত করে অ্যাডাপ্ট করেছে। তাই সেভাবে দেখলে বিষয়টা জানতাম আমি। এখানে তো আমার কিছু বলার নেই। চিত্রনাট্য আমি দেখিনি। চিত্রনাট্য লেখার আগে আমি, বিরসা আর মৈনাক (ভৌমিক) একদিন বসেছিলাম। তখন ওদের নানারকম আইডিয়া শুনেছিলাম। একটা আউটলাইনও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু চিত্রনাট্য তৈরি হবার পর আমি আর সেটা দেখতে চাইনি। চাইলে হয়ত ওরা দেখাত। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল ওটা আমার কাজ নয়। আমার কাজ উপন্যাস লেখা। সেটাই করেছি আমি। বাদবাকি কাজ ওদের।

বাংলাদেশে কাজ করতে আমি আর আগ্রহী নই: অরিন্দম

উপন্যাসের চরিত্রগুলো ছবিতে সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। অর্চি হয়ে গেছে ইরা, শতানিক হয়ে গেল মিস সেন, সাইমনের চরিত্রটাও পাল্টে গেল। গল্পে তো এভাবে ছিল না। পাঁচটা মেয়ের গল্পও ছিল না। নিজের গল্প পাল্টে গেলে লেখক হিসেবে কেমন লাগে?

আমার কেমন লাগে তার ওপর তো কিছু নির্ভর করে না। আমার অবশ্যই ভালো লাগত যদি গল্প অনুযায়ী ছবিটা তৈরি হতো। কিন্তু তা তো সবসময় হয় না। এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে ছবি করতে গিয়ে মূল গল্প পুরোটাই পাল্টে গেছে। এটা নতুন কিছু নয়। ওরা গল্পটাকে ওদের ফরম্যাটে ফেলে ভেবেছে। আমি এ ব্যাপারে একেবারেই কনজ়ারভেটিভ নই। গল্পের স্বত্ত্ব দিয়ে দেবার পরে সেটার ওপর আমার আর কিছু বলার থাকে না। আসল কথা হল, ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত আমার উপন্যাসটা তো কেউ পাল্টাতে পারবে না। সেটা তো থেকেই যাচ্ছে। ছবিটা কিভাবে হবে সেটা তো চিত্রনাট্যকার বুঝবে, প্রযোজক, পরিচালক বুঝবে। আমার ভালো লাগা না লাগার ব্যাপার এখানে আসেই না।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

এসভিএফ-কে গল্পের চিত্রসত্ত্ব দেওয়ার কোনও বিশেষ কারণ ছিল কি?

ওরাই আমার কাছে এসেছিল, কথা বলেছিল। বিরসার মাধ্যমেই সেই যোগাযোগটা হয়। আমার গল্পটা তো ২০০৭ থেকে পড়েই ছিল। শেষবার ছবির জন্য কোনও গল্পের সত্ত্ব দিয়েছি প্রায় দশ বছর আগে। এর মাঝে কিছু অফার আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়নি ওই গল্পগুলোর থেকে ভালো ছবি হতে পারে। তাই আমি রাজি হইনি। আর এসভিএফ এত বড় প্রযোজনা সংস্থা, না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। ওরা সিন্সিয়রলি কাজ করছে বাংলা ছবি নিয়ে। আর অর্থও একটা বড় কারণ। এটা যদিও অনেকেই স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটা অস্বীকার করার কোনও মানে হয় না। এরকম একটা বড় সংস্থা যখন আমার গল্প নিয়ে ছবি করতে চাইছে, তখন আমি চিত্রসত্ত্ব দেব না কেন? এর আগে ২০১০–এ দুজন প্রযোজকের সঙ্গে আলাদাভাবে ক্রিসক্রস নিয়ে কথা হয়েছিল। কিন্তু তা বেশি দূর এগোয়নি।

ছবি হলে বইয়ের প্রচারটাও বাড়ে

অবশ্যই। তাছাড়া এমন তো নয় যে সকলে প্রচুর বই পড়ে। অনেকে হয়ত বইটার নামই শোনেনি। তারা ছবিটা দেখে বইটা পড়বে। পুরস্কার পেলে আর ছবি হলে সেই বই নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ে। কারোর বইটা পড়ে ভালো লাগলে তখন সে হয়ত লেখকের অন্য বইয়েরও খোঁজ করবে। মানে এভাবেও তো বইয়ের প্রসার হয়। সেগুলোও তো মাথায় রাখতে হবে।

Advertisement

বিরসাকে গল্প দেবার কোনও বিশেষ কারণ ছিল কি? অন্য কোনও পরিচালক এলে তাকেও কি দিতে?

বিরসার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। ওর সঙ্গে প্রায়ই এই ধরণের কথা হয়। শুধু এসব নিয়েই নয়, নানান বিষয়ে কথা হয়। সেই সূত্রেই একটা ভরসার ব্যাপার ছিল। অন্য যেসব লেখা নিয়ে কেউ কেউ ছবি করার কথা বলেছে, সেগুলো আমার নিজেরই পছন্দ হয়নি। ক্রিসক্রস নিয়ে ছবি হতে পারে সেটা আমার নিজের মনে হয়েছিল।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। লেখালেখি কবে থেকে শুরু করলে? লেখা তো তোমার একমাত্র পেশা নয়। সারাদিন নিজের অফিস সামলে লেখার ব্যাপারটা কিভাবে ম্যানেজ করো?

টুকটাক লেখা শুরু করি ক্লাস সিক্সে। আর সিরিয়াস লেখা শুরু হয় ক্লাস নাইনে উঠে। লেখার প্রতি একটা ভালবাসা আছে বলেই কাজকর্ম সামলে রাত জেগে লিখি। এই টানটা না থাকলে তো প্রতিদিন রাত জাগতাম না। সারাদিন অফিস করে রাত জেগে লিখতে গিয়ে আমার কিডনি স্টোনের সমস্যা হয়েছে, ইনসমনিয়া আছে, স্পাইনাল কর্ডের সমস্যাও আছে। আরও অনেক কিছু আছে। তবু আমি লিখি কারণ লিখতে ভালো লাগে তাই। অফিস, লেখা আর ফুটবল দেখা, এর বাইরে আমি আর খুব কিছু করিও না। লোকজনের সঙ্গেও তেমন মিশি না, সোশ্যাল মিডিয়াতেও আমি নেই। তাই সেদিক থেকে অনেকটা সময় আমার বেঁচে যায়।

যে জন থাকে মাঝখানে

স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে চেতন ভগতের লেখার মিল আছে, এরকম একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। দুজনের লেখাতেই একটা শহুরে ফিল আছে

যারা এরকম বলেন, তারা আমার সব লেখা পড়েননি। আমার ষাট-সত্তরটা ছোটগল্প আছে যেগুলোর বেশিরভাগই মফস্বল বা গ্রামীণ পটভূমির ওপর লেখা। সেখানে শহর প্রায় নেই বললেই চলে। যারা আমার সব লেখা পড়েছে তারা এরকম অভিযোগ করবে না। আর চেতন ভগত প্রসঙ্গে বলি, উনি কতগুলো উপন্যাস লিখেছেন, আর কতগুলো গল্প মফস্বল বা গ্রাম নিয়ে লিখেছেন? দুজনে একই সময়ে লিখছি, সেই সূত্রে কিছু জিনিস দুজনের লেখাতে স্বাভাবিকভাবেই আসবে, যেমন ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, জামাকাপড়ের ব্র্যান্ড। এরকম মিল তো থাকতেই পারে। এছাড়া কোনও মিল আছে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া ওনার তো অনেকগুলো গল্প নিয়ে ছবি হয়েছে। ছবি করা যাবে এই ভেবেই উনি গল্প লেখেন এমনও শুনেছি। আমার আর কটা গল্প নিয়ে ছবি হয়েছে? আমি সেটা মাথায় রেখে লিখিও না।

ক্রিসক্রস-এর জন্য তুমি তিনটে গান লিখেছ—আলো ছায়া, মোমের শহর, আর দুনিয়া। এর মধ্যে শেষোক্ত গানটা যথেষ্ঠ জনপ্রিয় হয়েছে। পাকাপাকিভাবে গানের জগতে চলে আসার কোনও ইচ্ছে আছে?

একেবারেই না। আমি গান মানে বন্দুক বুঝি (হেসে)। গান শুনি ঠিকই, তবে তাই বলে গান লিখব এটা কোনওদিনই ভাবিনি। গান লেখার কোনও কথাই ছিল না। একটু আধটু কবিতা লিখি বলে বিরসা সুরটা পাঠিয়ে বলেছিল যদি কিছু করা যায়। সেইভাবেই লেখাটা আসে। কোনও চ্যালেঞ্জ নিয়ে লিখিনি। আগামীদিনে আর কখনও লিখব কিনা তাও জানি না। হয়ত লিখব, আবার নাও লিখতে পারি।

তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

তোমার আর কোনও গল্প নিয়ে ছবি বা ওয়েব সিরিজ় কিছু আসছে কি?

না। তেমন কোনও কিছুই হচ্ছে না। আবার হয়ত দশ বছর পরে কখনও হবে। এই মুহূর্তে কিছুই নেই। এমনকি লেখার হাতও খালি।

শেষ প্রশ্ন। তোমার প্রচুর ভক্ত রয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোমার ফ্যান ক্লাবও আছে। তারা কিন্তু এইভাবে ক্রিসক্রস-এর গল্প পাল্টে যাওয়ায় রীতিমত ক্ষুব্ধ। তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবে কি?

একটাই কথা বলব, আমার উপন্যাসটা তো রইল। ছবি ভালো না লাগলে উপন্যাসটা পড়ুন। আমার দায় শুধু আমার উপন্যাসটার প্রতিই। তার বাইরে গিয়ে কোনও কিছুর জন্য ভাবাটা আমার কাজ নয়। আর্ট বা সাহিত্যের বহুমাত্রিক ইন্টারপ্রিটেশন হবেই। আর্টের তো কোনও বাঁধাধরা ফর্মুলা হয় না। একই কবিতা বিভিন্ন বয়সে পড়লে বিভিন্ন রকম মানে বার করা যায়। এখন কারোর যদি খারাপ লাগে বা রাগ হয়, তাহলে সেটার ওপর আমার কোনও হাত নেই। তবু আমি বলব ছবিটাকে ছবি হিসেবেই দেখতে। আর আমার উপন্যাসটা তো আছেই। সেটা তো কেউ পাল্টাচ্ছে না।

Amazon Obhijaan

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *