উতরে দিলেন স্বস্তিকা
ছবি: শিবপুর
পরিচালনা: অরিন্দম ভট্টাচার্য
অভিনয়ে: স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, মমতা শঙ্কর, রজতাভ দত্ত, সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়, সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, সুমিত সমাদ্দার, সৌমেন ঘোষ, রাজদীপ সরকার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১২ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆
তিলোত্তমা কলকাতার যমজ ভাই হাওড়া। কলকাতার চেয়ে বেশি প্রাচীন ইতিহাস বুকে নিয়ে চলে এই শহর। যমজ ভাইয়ের মতোই এই শহরের বেড়ে ওঠার কাহিনিও ঘটনাবহুল। তবু রাজ্যের রাজধানী যেভাবে জনমানসে প্রাধান্য পেয়েছে, তার পার্শ্ববর্তী শহরটি ততখানি প্রাধান্য পায়নি। অন্ধকার জগতের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অপরাধের কালো মেঘ কলকাতার তুলনায় হাওড়ার ওপরেই বেশি বিরাজ করেছে। তার একটা কারণ এ জেলার বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চল। হাওড়ার জনবহুল অংশে একসময় চলত মাফিয়ারাজ। বহু চেষ্টা করে তবে পুলিশ তা দমন করতে সক্ষম হয়। সেই সত্য ঘটনা অবলম্বনেই অরিন্দমের ছবি ‘শিবপুর’।
ছবির শুরুতে দেখা যায়, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার সুলতান আহমেদ (পরমব্রত) একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে সাংবাদিক পারমিতাকে (সুস্মিতা) সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সুলতানকে তাঁর অতীতের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ঠারেঠোরে উত্তর দিতে থাকেন। বেশ কিছু কুখ্যাত লোকের নাম করে পারমিতা। তাদের কথা এড়িয়ে গিয়ে সুলতান জানায়, এসব কথা তার আত্মজীবনীতে লেখা থাকবে। সাক্ষাৎকার শেষে পারমিতা আবারও তাদের—বিশেষ করে মন্দিরা দাসের (স্বস্তিকা)—কথা জিজ্ঞাসা করে। সুলতান এড়িয়ে যায়। এরপর রাতে এক রহস্যময় ফোন আসায় সুলতান পরের দিন পারমিতাকে ডেকে পাঠায় এবং মন্দিরার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে বলে তাকে এক জায়গায় নিয়ে যায়। সেই পথেই চলে অতীতমন্থন।
আরও পড়ুন: “আর ভালো লাগছে না”
এই অতীতের কথায় এক রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে জর্জরিত হাওড়া শহরকে দেখা যায়। সে শহর শাসন করে এক মাছ ব্যবসায়ী তপন বারিক (খরাজ) ও এক জমিদার নেপাল (রজতাভ)। দুজনেরই অপরাধ জগতের অতীত রয়েছে। বহু মানুষকে হত্যা করে এদের ক্রমাগত উত্থান ঘটেছে। স্বামীর হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তপনের হাত ধরে অপরাধজগতে মন্দিরার প্রবেশ। পরে অবশ্য সে তপন ও নেপাল, দুজনেরই চিরশত্রু হয়ে যায়। একসময় সরকার থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে শিবপুরের অপরাধ দমন করতে আসে সুলতান।
এ ছবির সবথেকে বড় সম্পদ স্বস্তিকার অভিনয়। পর্দায় প্রতিটি ফ্রেমে তিনি নিজেকে মেলে ধরলেন। হাওড়া শহরের অপরাধের ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষরা অন্যান্য বেশ কিছু চরিত্রকে চিনতে পারলেও মন্দিরা কার মোড়কে গড়া, তা নিয়ে ভাবতেই পারেন। তপনের মতো বেপরোয়া গুণ্ডার চরিত্রে খরাজকে একেবারে নিখুঁত মানিয়েছে। নেপালের মতো পালিশকরা খলচরিত্রে রজতাভ যথাযথ। তবে সুলতানকে কাহিনির অংশ কম, সূত্রধর বেশি মনে হয়েছে। সুলতানরূপী পরমব্রতর পর্দায় উপস্থিতিও খুবই কম। পুরোপুরি বাস্তবনির্ভর কাহিনি নির্মাণ না করায়, সুলতানের চরিত্রটি না রেখে সুমিত অভিনীত পুলিশ অফিসারটিকে দিয়েও একই কাজ করিয়ে নেওয়া যেত। একটি বিশেষ চরিত্রে মমতা শঙ্কর অনবদ্য। তবে পারমিতারূপী সুস্মিতার এই ছবিতে বিশেষ কিছু করার ছিল না।
আরও পড়ুন: “প্রতিটি আঞ্চলিক সিনেমার শিকড় কোথায় আমি জানি”
ছবির চিত্রনাট্য রচনায় অরিন্দম সাহস দেখালেও কাহিনি নির্মাণ আরও মুচমুচে হতে পারত। ছবির বেশ কিছু অংশ দীর্ঘ বলে মনে হয়। অপরদিকে বেশ কিছু অংশ দেখলে মনে হয় সেখানে আরও সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করা যেত। যেমন তপন বনাম নেপালের শত্রুতার সূত্রপাত কী নিয়ে তা বোঝা গেল না।
হাওড়ার মাফিয়ারাজের পিছনে ছিল রাজনৈতিক টানাপোড়েন। যে দুই দশকের ওপর ভিত্তি করে এই ছবি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পালাবদলগুলির ওপর নজর দিলে ভালো হতো। ছবিটি দেখতে বসে মনে হতে পারে, এ যেন শুধুই মন্দিরা দাসের কাহিনি। তপন বা নেপালের বিপুল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ছবির দ্বিতীয়ার্ধে তাদের যেন কেউটে খুঁড়তে কেঁচোর মতো দেখানো হলো। অরিন্দম যে কাহিনি বলতে চেয়েছিলেন, তার জন্য হয়তো দু’ঘণ্টার বদলে চারঘণ্টা সময় নিয়ে, পরিষ্কারভাবে, গুছিয়ে, ওয়েব সিরিজ় হিসেবে দেখানো যেত।
এই ছবির বড় পাওনা অমিত চট্টোপাধ্যায়ের সুর। আবহ হোক বা প্রয়োজন মতো পরিমিত গানের প্রয়োগ, উভয়েই তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
‘শিবপুর’ ভালোলাগার কারণ যদি হয় অভিনয় এবং দুর্দান্ত সংলাপ, তাহলে দুর্বল দিক হলো এ ছবির নির্মাণ। প্রসেনজিৎ চৌধুরীর চিত্রগ্রহণ ও সুজয় দত্ত রায়ের সম্পাদনা আরও নিপুণ হতে পারত। সামান্য যেটুকু ভিএফএক্সের কাজ হয়েছে, তাতে অপটুতার ছাপ স্পষ্ট। সুলতানের বৃদ্ধবয়সে পরমব্রতর প্রস্থেটিক মেকআপ বেশ দৃষ্টিকটু। ছবির সাবটাইটেলের মধ্যে ভুল বানানগুলির ওপর চোখ পড়লে বিরক্তির উদ্রেক হয়। এই বিষয়গুলিতে আরও বেশি করে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল।
তবু ভালোখারাপ মিশিয়ে ‘শিবপুর’কে উতরে দিলেন স্বস্তিকা। শুরু থেকে শেষ, গোটা ছবিজুড়ে কোনও অভিনেত্রীর এমন দাপুটে উপস্থিতি শেষ কবে বাংলা ছবিতে দেখা গিয়েছে মনে পড়ে না। তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের লোভেই বর্ষার বিকেলে একবার দেখে আসাই যায় হাওড়ার মাফিয়ারাজের কাহিনি ‘শিবপুর’।