থতমত এই শহরে রডোডেনড্রন

ছবি: শহরের উষ্ণতম দিনে

পরিচালনা: অরিত্র সেন

অভিনয়ে: বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, শোলাঙ্কি রায়, দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, অনামিকা চক্রবর্তী, রাহুল দেব বসু, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ রায়চৌধুরী, সুদীপা বসু, রেশমি সেন, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

কলকাতার একটা অদৃশ্য টান আছে। সেটা বোঝা যায় কলকাতার বাইরে গেলে। কথাটা অস্বীকার করা মুশকিল। এই শহরে না থাকলেও কলকাতাকে ভুলে থাকা সম্ভব নয় । আমাদের প্রতিদিনের ওঠাপড়া রোজনামচায় একটা আস্ত শহর কীভাবে আর কতটা জুড়ে থাকে তার হিসেব রাখার কথা আমাদের যেন মনেই থাকে না। সেই কলকাতাকে ঘিরেই ঘুরপাক খায় অরিত্রর ছবি। সম্পর্কের টানাপোড়েন আর বন্ধুত্বের ভাঙাগড়ায় যেখানে ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে রইল এই সেন্টিমেন্টাল শহরটাও। 




ছবির গল্প কলকাতার কিছু ছেলেমেয়েকে ঘিরে। একই কলেজের ছাত্রছাত্রী অনিন্দিতা (শোলাঙ্কি), ঋতবান (বিক্রম), ক্রিস্টিন (অনামিকা), সায়ক (দেবপ্রিয়) ও রেহান (রাহুল)। কলেজ জীবন পার করে তারা বাস্তবের কঠিন জমিতে পা রাখে। ফটোগ্রাফি ভালোবাসলেও বাবা-মায়ের ইচ্ছাপূরণ করতে বিদেশে পড়তে চলে যেতে হয় ঋতকে। শহরকে ভালোবেসে এবং কিছুটা পরিস্থিতির চাপেও আটকে পড়ে অনিন্দিতা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় বন্ধুরা। অবশেষে একসময় আবার দেখা হয় তাদের। সেদিনের ঘেঁটে যাওয়া হিসেবগুলো কি এবার তারা মিলিয়ে নেবে? নাকি ভেতরে থেকে যাবে অনেকগুলো না বলা কথা, ইগো আর অভিমানের লড়াই? 

আরও পড়ুন: “প্রতিটি আঞ্চলিক সিনেমার শিকড় কোথায় আমি জানি”

কলকাতা আসলে যতটা এখানে আজীবন বেড়ে ওঠা বাসিন্দার, ততটাই ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায় এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া আরও অনেকের। বন্ধুত্ব, হুল্লোড়, হঠাৎ প্রেম, ঝগড়া, সিদ্ধান্তহীনতা, কমিটমেন্ট ফোবিয়া, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, এ যেন আগাগোড়া সব প্রজন্মেরই গল্প। প্রত্যেকটা মানুষের মতো প্রত্যেকটা জীবনও আলাদা, তবু গল্পগুলো কোথাও গিয়ে যেন মিলে যায়। বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে কত অজানা অচেনা রঙিন ইচ্ছের অকালমৃত্যু ঘটে যায় সে হিসেব কি কেউ রাখে! কত দিনবদলের অঙ্গীকার, বিপ্লবের স্বপ্ন কলকাতার প্রাচীন গলির আদ্যিকালের বাড়িতে পচেগলে শেষ হয়ে যায়। হয়তো বা সেখানেও ফোটে নতুন আশার ফুল। কেই বা খবর রাখে! এই সবের মধ্যে দিয়েও এ ছবিতে বয়ে গেছে অন্তঃসলিলা ভালোবাসা। রয়ে গেছে চেনা কলকাতাও। বাড়ির ভাড়াটে কাকুর মতো যে মাথায় একটা মায়াময় হাত রাখে খুব কঠিন দিনেও। বাইরের কঠোর বাস্তবের মতো এই মায়াটুকুও এ শহরের একান্ত নিজস্ব। এ ছবির আগাগোড়াই খুব চেনা, বহুবার আলোচিত, নানা গল্পে নানাভাবে উঠে আসা কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে। তবু যেন কিছু নতুন করে বলা। আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া বন্ধুত্বের কথা, ভালোবাসার কথা, জীবনের কথা। যা লক্ষবার বললেও যেন কখনও পুরনো হয় না। 



সেভাবে টানটান কোনও প্লট না থাকা সত্বেও দেখতে বসে কোথাও ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ একঘেয়ে লাগে না। ঋত আর অনির গল্প জীবনের বেশ কিছু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যায় হাওয়ার গতিতে। ছবির শেষ একেবারেই অনুমেয় নয়। দর্শকের কল্পনার রাস্তাটুকু খুলে রাখেন পরিচালক। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেই যে জীবনের লড়াইটা খাটো হয়ে যায় না, সেটা সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন অরিত্র।

কয়েকটি দৃশ্য একটু অন্যভাবে দেখা গেলে ভালো লাগত। কলেজে যেখানে প্রথমবার অনিন্দিতা ও ঋতবানের দেখা হচ্ছে, সেখানে বন্ধুরা এসে নাম বলে আলাপ করায়। এভাবে প্রথাগত আলাপ কলেজের প্রেক্ষাপটে বেমানান। কলেজে সবাই সবাইকে চিনে যায়, আলাদা করে আলাপের দরকার পড়ে না। এছাড়া অনিন্দিতার সঙ্গে তার বাবার সম্পর্কে যে পরিবর্তন আসে সেটাও আর একটু সময় নিয়ে দেখানো গেলে ভালো হতো। 

আরও পড়ুন: “আর ভালো লাগছে না”

ছবিতে অজস্র পণ্যের বিজ্ঞাপন খুব চোখে লাগে। ইদানিং বেশ কিছু ছবিতে এ জিনিস দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতারা কি দর্শকদের এতটাই বোকা ভাবেন যে কোনও বিশেষ দৃশ্যে বিশেষ ব্র্যান্ডের উপস্থিতি তারা বুঝবে না বা পড়তে পারবে না? ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করিয়ে অযথা চরিত্রদের বিব্রত করে ছবির বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দেওয়াই কি তাদের উদ্দেশ্য?  

বিক্রম-শোলাঙ্কি জুটির রসায়ন এই ছবির অনেকটা জুড়ে। দুজনকে একসঙ্গে দেখতে ভালো লাগে। দুজনেই নিজেদের চরিত্রে সেরাটুকু দিয়েছেন। দ্বিতীয় ছবি হিসেবে শোলাঙ্কিকে অনেকটাই পরিণত ও সপ্রতিভ লেগেছে। সায়কের মতো এক জটিল চরিত্রে মুগ্ধ করে দেবপ্রিয়র অভিনয়। নানা ধরনের কঠিন চরিত্রে নিজেকে অনায়াসে মেলে ধরেন তিনি। ক্রিস্টিন ও রেহানের চরিত্রে অনামিকা ও রাহুলের অভিনয় খুব প্রাণবন্ত। অভিজ্ঞ চরিত্রাভিনেতা দেবেশ ও সুদীপা দুজনেই যে যার জায়গায় অনবদ্য। অনিন্দিতার নতুন বয়ফ্রেন্ডের চরিত্রে অনিন্দ্য বেশ মানানসই। তবে উচ্চারণের ব্যাপারে তাঁর আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। রেশমি এবং সিদ্ধার্থ নিজেদের চরিত্রে যথাযথ। খুব ছোট্ট চরিত্রে সুজয়ের অভিনয় অসম্ভব মায়াজড়ানো, অতটুকু সময়ের মধ্যেই দর্শককে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। 



নবারুণ বসু ও আকাশ চক্রবর্তীর সুরে ছবির গানগুলো মিষ্টি। অর্ণব দাসের গলায় ‘রাতের কাছে’ এবং লগ্নজিতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘টাইম মেশিন’ বারবার শোনা যায়। বাসুদেব চক্রবর্তীর ক্যামেরায় কলকাতাকে দেখতে দারুণ লাগে। সৌম্যশ্রী ঘোষ ও অনুপ্রিয়া দত্তের চিত্রনাট্য এবং অরিত্র সেনগুপ্তর সংলাপ দর্শকের ভালো লাগবে।

‘ঘরে ফেরার গান’-এ টেমসপারের শহরের গল্প বলেছিলেন অরিত্র। দ্বিতীয় ছবিতে বেশ অন্যভাবে গঙ্গাপারের শহরের গল্প শোনালেন তিনি। বর্ষার দিনে চিরচেনা কলকাতাকে বড়পর্দায় নতুনভাবে পেতে ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ দর্শক খানিক ভিজে আসতেই পারেন। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *