আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতো চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়াস

ছবি: ঘুণ

পরিচালনা: শুভ্র রায়

অভিনয়ে: সৌরভ দাস, অনুশা বিশ্বনাথন, কৌশিক ঘোষ, সমদর্শী দত্ত, শুচিস্মিতা ঠাকুর, পৌলমী দাস, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রবিরঞ্জন মৈত্র

দৈর্ঘ্য: ১২০ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।’

আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনের মূল সুর বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই একটি পংক্তিতেই বাঁধা। নাগরিক জীবনের সঙ্গে অবধারিতভাবে জড়িয়ে থাকে অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাকে পাওয়ার জেদ, তার অপূর্ণতায় তৈরি হওয়া হতাশা এবং সেই সূত্রে সম্পর্ক ভাঙার শূন্যতা। সবশেষে পড়ে থাকে অশেষ ক্লান্তি। এতরকম জটিলতা মানুষ এক জীবনে স্বেচ্ছায় সৃষ্টি করে যে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাকে অনেক সময়েই মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। সাময়িক মোহের বশে করে ফেলা ভুলের মাশুল গুনতে হয় বাকি জীবন ধরে। 




ইদানিং বাংলা ছবি দুটো ধারা মেনে নির্মিত হয়। একটি হলো রহস্য। এর মধ্যে আবার দুটি ভাগ রয়েছে, গোয়েন্দা এবং থ্রিলার। দ্বিতীয়টি হলো সম্পর্ক। এই দ্বিতীয় পথে হেঁটেই শুভ্র তাঁর প্রথম ছবি ‘ঘুণ’-এর মাধ্যমে তুলে ধরলেন জটিল থেকে জটিলতর নানান সম্পর্কের সমীকরণ। কাঠের মতোই দীর্ঘদিন একই নিয়মে চলতে চলতে সম্পর্কেও ঘুণ ধরে। কাঠে ঘুণ ধরলে যেমন তাকে ফেলে দিয়ে নতুন আসবাব বানাতে হয় বা সারিয়ে নিতে হয়, সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাই।

দু’ঘন্টার ছবি জুড়ে এই সম্পর্ক মেরামতির কাজটাই করে গেলেন অভিনেতারা। তার কিছু হয়তো মেরামত করা গেল, কিছু আবার বাদও দিতে হলো। বিক্রম, পুনম, জয়, বিনীতা, অমিত, সিম্মি। এই ছ’টি চরিত্র নিয়ে শুরু হয় ‘ঘুণ’-এর গল্প। শুরুর প্রায় ৪৫ মিনিট বিভিন্ন ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘটনার কোলাজ দর্শককে ধোঁয়াশায় রাখে। বিশেষ ধৈর্য প্রয়োজন এই সময়টা প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকার জন্য। তবে তারপরে ছবি গতি পায়। ক্রমশ পরিস্কার হয় চরিত্রগুলির মধ্যেকার সমীকরণ।

আরও পড়ুন: নন্দন সহ আরও ১৫টি প্রেক্ষাগৃহে এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

এই ছবিতে আপাতদৃষ্টিতে গল্প তিনটি—উচ্চাকাঙ্খার, জীবনের পথে ওপরে ওঠার সহজ সমাধান খোঁজার, আর মরে যাওয়া সম্পর্কের মধ্যে দম বন্ধ করে বেঁচে থাকার। কিন্তু একটা সময়ের পর এই তিনটি গল্পই জুড়ে যায় একে অন্যের সঙ্গে, এবং তা নিজেদের অজান্তেই। 

বেঙ্গালুরু ফেরত জয় প্রযোজকদের দরজায় হত্যে দেয় চিত্রনাট্য নিয়ে। কিন্তু সে মানবিকতাকে বিসর্জন দিতে পারে না কাজের নামে। জয় যাকে ভালোবাসে তার কাছ থেকে নিরন্তর অবহেলা পেয়ে সে নির্লিপ্ত হয়ে যায়। আর একদিকে নিজের উচ্চাশাকে চরিতার্থ করতে যা খুশি করতে পারে পুনম। তার কাছে কাজটাই আসল। যে কোনও মূল্যে তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতেই হবে। স্ত্রী বিয়োগের পরে বিক্রমের প্রয়োজন নারীসঙ্গ। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে জীবনের সমস্ত আনন্দ দুহাতে লুটে নিতে চাইলেও নিজের মেয়ের ব্যাপারে তার নীতিবোধ প্রবল। পেশায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অমিত ব্যক্তিগত জীবনে সারাক্ষণই এক দোটানায় ভেসে থাকে, পুরোনো সম্পর্ককে আবার জীবিত করবে নাকি সরে আসবে তার থেকে? সিম্মি তার অল্পবয়সের উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে জেদের বশে অন্ধকার জগতে পা বাড়ালেও নিজের স্বপ্নের জন্য সে কোথাও আপোষ করতে রাজি নয়। অন্যদিকে শিশুপুত্রের অকাল মৃত্যুতে জীবন্মৃত বিনীতা স্বামীর সাহচর্য প্রার্থনা করেও ক্রমাগত হতাশ হয়। মরে যেতে থাকে তার ভেতরের সত্বা। জীবনের নানান বাঁকে উঠে আসা নিত্যনতুন বাধাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া কিংবা লড়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলে ছবির গল্প।

আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে

সৌরভকে এই ছবিতে পাওয়া গেল একেবারেই ভিন্ন এক চরিত্রে। তিনি প্রমাণ করলেন, জয়ের মতো ধীর স্থির ঠান্ডা ও নরম মানুষের চরিত্রেও তিনি সফলভাবে উতরে যেতে পারেন। সিম্মির চরিত্রে অনুশা স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণোচ্ছল। পুনমের চরিত্রে পৌলমী যথাযথ। বিনিতার ভূমিকায় শুচিস্মিতা আন্ডারঅ্যাক্টিংয়ের মাধ্যমে চরিত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সর্বত্র সফল না হলেও চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। বিক্রমের চরিত্রে কৌশিক বেশ ভালো। গোটা ছবি জুড়ে তার দাপট দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই। তবে অমিতের ভূমিকায় সমদর্শী আরও একটু স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারতেন। তাঁর অভিনয় কোথাও দাগ কাটলো না। নির্লিপ্ততা বোঝাতে তিনি গোটা ছবিতে একইরকম ‘ফ্ল্যাট ফেস’ ব্যবহার করে গেলেন। প্রযোজকের চরিত্রে রবিরঞ্জনও মানিয়ে গিয়েছেন। স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন সিম্মির বন্ধু (দিগন্ত সাহা)। অনুশার সঙ্গে প্রয়োজনমতো সঙ্গত করে গেলেন তিনি।

মনে বিশেষভাবে দাগ কেটে যায় রূপঙ্কর বাগচীর ‘হারিয়ে যেতে হয়’ গানটি। ছবির শুরুর দিকের সম্পাদনা আরও একটু টানটান হতে পারতো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো মূল কাহিনীতে ঢোকার জন্য। তবে ছবির দৈর্ঘ্য একটু বেশি হলেও শেষের অংশটা মনকে তৃপ্তি দেয়। বাধাঁধরা নিয়মের বাইরে গিয়ে অন্যরকম ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে গল্পের শেষ মোচড়ে। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে চূড়ান্ত নাটকীয়তার লোভ সংবরণ করেছেন শুভ্র, যা দর্শকের চোখকে আরাম দেবে।

এতরকম চরিত্রের ভিড়ে পরিচালকের একটি বক্তব্য স্পষ্ট, সম্পর্কে ঘুণ ধরে গেলে তাকে জমিয়ে না রেখে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। হয় তাকে ফেলে দাও, কিংবা মেরামত করো, শুধু জমিয়ে রেখে দিও না। ছবিতে নীতিবোধকে ঘিরে এক অনুচ্চারিত সুর একাধিকবার ফিরে আসে, যার ফলে আশা জাগে এত জটিলতাতেও হয়তো এই প্রজন্ম পথ হারাবে না।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *