‘স্যাটা বোস এখন আর শুধুমাত্র বাঙালির সম্পত্তি নয়, আমার তো নয়ই’
মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ওরফে শংকরের উপন্যাস চৌরঙ্গী অবলম্বনে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত শাহজাহান রিজেন্সি মুক্তি পাচ্ছে ১৮ জানুয়ারী। প্রকাশের পর গত ৫৭ বছর ধরে একইভাবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই উপন্যাস নিয়ে ১৯৬৮ সালে একই নামের ছবি পরিচালনা করেন পিনাকী মুখোপাধ্যায়। একান্ত সাক্ষাৎকারে রেডিওবাংলানেট-কে লেখক জানালেন, অর্ধশতক পেরিয়ে আবার এই উপন্যাস থেকে ছবি করার স্বত্ব তিনি কেন দিলেন সৃজিতকে।
১৯৬৮-তে যে ছবিটি হয়েছিল তা এখনও বাংলা ছবির জগতে একটা মাইলস্টোন হিসেবে গণ্য হয়। তার চেয়েও বড় কথা উত্তমকুমার অভিনীত ছবির তালিকায় চৌরঙ্গী অন্যতম জনপ্রিয় একটি নাম যা বাঙালির সবথেকে প্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে একটি। তাহলে পঞ্চাশ বছর পর আবার কাউকে নতুন করে একই গল্পের স্বত্ব দিলেন কেন ?
আমি যেখানে বড় হয়েছি, সেখানে আমার প্রতিবেশী ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমি ওনাকে চিনতাম না যদিও, তবু কথাটা এই কারণে বলছি যে ওনার তো প্রচুর গল্প নিয়ে নানান মাধ্যমে কাজ হয়েছে। একই গল্প নিয়ে একাধিকবার ছবি হয়েছে। সেখান থেকে একটা জিনিস বোঝা যায় যে একটা গল্পের স্যাচুরেশন পয়েন্ট বলে কিছু হয় না। একই গল্প বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তার সঙ্গে সময় পাল্টেছে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টেছে। একটা গল্প বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজন্মকে তাদের মত করে বলা যেতেই পারে। তাই নতুন করে যদি কেউ আমার গল্প নিয়ে কাজ করতে চায় তাহলে আপত্তির তো কারণ থাকার কথা নয়।
বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
শাহজাহান রিজেন্সি ঘোষণার দিন আপনি মজা করে বলেছিলেন মুখোপাধ্যায় গোত্র ছাড়া আপনি চৌরঙ্গীর স্বত্ব আর কাউকে দেবেন না। সেই কারণেই কি পিনাকীবাবুর পর সৃজিতকে গল্পের স্বত্ব দিলেন, নাকি তার যোগ্যতাই এখানে মাপকাঠি ছিল?
অবশ্যই যোগ্যতাই শেষ কথা। মুখোপাধ্যায়টা একেবারেই মজা করে বলা। আসলে একজন লেখকের কাছে তার সব লেখাই হল মেয়ের মত। সেই গল্প থেকে ছবি, নাটক কিংবা নৃত্যনাট্য, যাই হোক না কেন, সবই হল আসলে তার জামাই। গোত্র না জেনে তো আর কন্যা পাত্রস্থ করা যায় না (হেসে)। যার হাতে দিচ্ছি সে তার যোগ্য কিনা তা তো দেখতেই হবে। তারপরে গিয়ে কি হবে সেটা তো আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। তবু দেওয়ার সময় যোগ্যতা দেখতে হয় বই কি। আর তার থেকেও বড় কথা, চৌরঙ্গী যখন আমি লিখেছিলাম তখন এ গল্প আমার ছিল। তারপরে এতকাল ধরে এত মানুষ এই গল্প পড়েছেন, এত মানুষ এই উপন্যাসটিকে গ্রহণ করেছেন যে চৌরঙ্গীকে আর শুধুমাত্র আমার সম্পত্তি বলে আটকে রাখার কোনও প্রয়োজন দেখি না।
চৌরঙ্গী যে সময়ের গল্প সেই সময়ের পাঁচতারা হোটেলের জীবনযাত্রার সঙ্গে বর্তমান সময়ের কতটা মিল রয়েছে বলে আপনার মনে হয়? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ১৯৬২ সালে লেখা গল্পের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?
প্রাসঙ্গিকতা ছিল এবং আছে। থাকবেও চিরকাল। কুড়িটিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে এই উপন্যাস। ভারতীয় ভাষায় তো আগেই হয়েছিল। এই বিভিন্ন ভাষার মানুষ কিন্তু তাদের নিজেদের ভাষায় পড়েই এই গল্পকে গ্রহণ করেছেন। এর থেকে একটা জিনিস পরিস্কার যে কিছু আবেগ এমন হয় যা সর্বকালে সব দেশেই সমান। তার আবেদনও সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে মানুষের মনকে ছুঁতে পারে। তাই সেভাবে দেখলে স্যাটা বোস এখন আর শুধুমাত্র বাঙালির সম্পত্তি নয়, আমার তো নয়ই। আমি তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না। মানুষ তাকে বহু আগেই নিজের করে নিয়েছে। সম্প্রতি চীনা ভাষাতেও চৌরঙ্গী অনুবাদ হয়েছে। তার মানে চীনের মানুষও চৌরঙ্গী পড়ছে। সেখানকার পাঠকদের এই গল্প ভালো লেগেছে, তারাও তাকে আপন করেছে। এই যে নানানভাবে এত মানুষের কাছে গল্পটা পৌঁছনো গেল এটা তো একটা বিরাট বড় পাওয়া।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
চৌরঙ্গী ছাড়াও আপনার অন্য গল্প নিয়েও বিভিন্ন সময়ে কাল্ট ছবি হয়েছে, যেমন যেমন জন অরণ্য বা সীমাবদ্ধ। এই গল্পগুলো নিয়েও কি দ্বিতীয়বার ছবি হতে পারে? বা আপনার নতুন কোনও গল্প নিয়ে কি আগামী দিনে কোনও ছবি হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
না, সেরকম কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। আসলে ছবি হবে ভেবে তো কখনও কোনও উপন্যাস লিখিনি আমি। ছবি যখন হওয়ার তখন তা আপনিই হয়েছে। তবে নিজের লেখা থেকে ছবি হলে সব সময়েই ভালো লাগে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছয় গল্পটা। তাই ভবিষ্যতে তেমন কিছু হলে ভালোই লাগবে এটুকু বলতে পারি।
ছবি: প্রবুদ্ধ