ভয় মেশানো রোমান্টিসিজ়ম আর শেষটুকু উজাড় করে দেওয়া অভিনয়

ছবি: রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট

পরিচালনা: প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য

অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, জ্যোতিকা জ্যোতি, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, অপরাজিতা ঘোষ, সোহম মৈত্র, সায়ন ঘোষ, গার্গী মাঝি

RBN রেটিং: ৪/৫

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বের সূচনাতে লিখেছিলেন, “যাহার পা-দুটা আছে, সেই ভ্রমণ করিতে পারে; কিন্তু হাত দুটা থাকিলেই ত আর লেখা যায় না। সে যে ভারি শক্ত।” সেই শক্ত কাজটিই তাঁর ছবিতে প্রায় নিখুঁতভাবে করে দেখালেন প্রদীপ্ত। প্রায় ১০০ বছর আগে লেখা উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’কে সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজস্ব আঙ্গিকে চিত্রিত করতে চেয়েছিলেন পরিচালক। সেই কাজে তিনি ১০০ ভাগ সফল। এক অদ্ভুত ম্যাজিকের মায়া জুড়ে রইল সারা ছবিতে। প্রদীপ্তর দাবী ছিল, এই ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ আপাদমস্তক তাঁর নিজস্ব গল্প। তাই শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ পড়া থাকুক বা না থাকুক, তার কারণে এই ছবি অনুধাবনে কোনও সমস্যা হবে না।




কৈশোর থেকে যুবা বয়েসের বিভিন্ন স্তরে শ্রীকান্ত (ঋত্বিক) বহু মানুষের সংস্পর্শে এলেও, ছোট থেকেই তার নানান দুঃসাহসিক কাজের অনুপ্রেরণা ছিল ইন্দ্রনাথ (সায়ন)। তাই গভীর রাতে শ্মশান থেকে কঙ্কাল তুলে আনাই হোক, বা নদীতে মাছ ধরা, সবকিছুতেই ইন্দ্রদার ছায়াসঙ্গী শ্রীকান্ত। গ্রামের বুজরুক সাহুজির স্ত্রী অন্নদাদির (অপরাজিতা) সঙ্গে ইন্দ্রর প্রেমের সম্পর্কের সাক্ষীও সেই শ্রীকান্ত। সাহুজির হাতে অন্নদাদিকে বারবার অত্যাচারিত হতে দেখে শ্রীকান্ত রাগের মাথায় খুন করে তাকে। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় ইন্দ্র ও অন্নদা। বড় হয় শ্রীকান্ত।

প্রদীপ্তর শ্রীকান্তও স্বভাবে ভবঘুরে। তাই হঠাৎ করে পুরোনো বন্ধু হুকুমচাঁদের (রাহুল) শিকার অভিযানের নিমন্ত্রণ পেয়ে নিজের চাকরি ছেড়ে বেরিয়ে পরে সে। শিকারে গিয়ে এক নতুন রূপে আবিষ্কার করে তার ছোটবেলার প্রেমকে। তার রাজলক্ষ্মী (জ্যোতিকা) এখন হুকুমচাঁদের রক্ষিতা পিয়ারীবাঈ। ছোট থেকেই ইন্দ্রদার আদর্শে বড় হওয়া শ্রীকান্ত যে কোনও সাহসিকতার কাজ করার আগে শুনতে পায় ইন্দ্রদার ‘ভয় পাস না শ্রীকান্ত’ আশ্বাসবাণী। কোথাও যেন ইন্দ্রদার জীবনের সঙ্গে তার নিজের জীবনের গল্পটাই মিলে যায় এই ছবিতে। রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত স্বপ্ন দেখে কলকাতায় এসে নতুন সংসার পাতার। এরই মাঝে হঠাৎ তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ইন্দ্র-অন্নদার।

আরও পড়ুন: পুজোয় রবীন্দ্র সদনে বাংলা ছবি, সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের

শুভদীপ দের ক্যামেরায় এবং সাত্যকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহসঙ্গীতের আমেজে ভীষণ জীবন্ত হয়ে ওঠে ছবির প্রত্যেকটি দৃশ্য এবং চরিত্র। একটি টানটান উত্তেজনামূলক গল্পের পরিবর্তে, ধীর গতিতে সময়, স্থান ও সম্পর্কের কোলাজ তৈরি করেছেন প্রদীপ্ত, যার রেশ ছবি শেষ হওয়ায় পরেও থেকে যায়। আধো আলো আবছায়ায় এক দারুণ সুন্দর ভয় মেশানো রোমান্টিসিজ়ম ছবিটিকে এক আলাদা ভালো লাগার জায়গায় নিয়ে যায়।

অভিনয়ে প্রত্যেকেই নিজেদের শেষটুকু উজাড় করে দিয়েছেন। কৈশোর বয়সের রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তের চরিত্রে গার্গী এবং সোহমের অভিনয় প্রশংসনীয়। ঋত্বিক তাঁর স্বকীয় স্টাইল বজায় রেখে এই ছবিতেও আরও একবার অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিলেন। তবে প্রদীপ্তর ছবির সেরা প্রাপ্তি সায়ন এবং অন্নদাদির চরিত্রে অপরাজিতা। প্রদীপ্তই একমাত্র চিনেছেন অপরাজিতাকে। এরকম অভিনয় ক্ষমতার অধিকারিণী হওয়া সত্বেও বাংলা চলচ্চিত্র ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি তাকে। রাজলক্ষ্মীর ভূমিকায় বাংলাদেশের অভিনেত্রী জ্যোতিকার অভিনয় তাঁকে ভারতীয় বাংলা ছবির জগতে এক আলাদা স্থান তৈরি করে দেবে আশা করা যায়। তাঁর প্রথম ভারতীয় ছবিতে ভীষণ সাবলীল অভিনয় করে গেলেন জ্যোতিকা। হুকুমচাঁদের ভূমিকায় রাহুল অনবদ্য।

আরও পড়ুন: গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই

অনির্বাণ দাসের কথায় ও সুরে গানগুলি ছবির অপরিহার্য অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বহুদিন হয়ে গেল বাংলা ছবির গানে আর এ ধরণের কথা লেখা হয় না। 

প্রদীপ্ত দাবি করেছিলেন তাঁর এই ছবি পুরোনো ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’র রিমেক নয় কোনওভাবেই। কথা রাখলেন তিনি। শুধু রাখলেনই না, শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আতঙ্ক কাটতে চায় না, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ঠিক সেরকমই একটি ছবি। শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তর কি হয়েছিল তা জানা যায়নি। পরিচালক সেই উত্তর খুঁজে দিয়েছেন তাঁর ছবিতে। শেষ পর্যন্ত এক মায়াবী রহস্যের জালে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করায় তিনি সফল।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *