প্রেক্ষাগৃহে বসে দার্জিলিং ভ্রমণ

ছবি: মাস্টার অংশুমান

পরিচালনা: সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়

অভিনয়ে: স্যমন্তক দ্যুতি মৈত্র, সোম চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়াঙ্কা উপেন্দ্র, সুপ্রিয় দত্ত, রজতাভ দত্ত, দেবেশ রায়চৌধুরী, রবি কেম্মু, চঞ্চল ঘোষ, অরিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৪ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆

সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ও শঙ্কু কাহিনিগুলি বাদ দিলে তাঁর যে বিপুলসংখ্যক অন্যান্য ছোটগল্প পড়ে থাকে, তা নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয় না। ফেলু-শঙ্কু ছাড়া মাত্র দুটি উপন্যাস সত্যজিৎ লিখেছিলেন। তার মধ্যে ‘ফটিকচাঁদ’ সন্দীপ রায় আগেই বড়পর্দায় নিয়ে এসেছেন। ‘ফটিকচাঁদ’ মুক্তির ঠিক চার দশক পর, সত্যজিতের অপর উপন্যাস ‘মাস্টার অংশুমান’ এবার বড়পর্দায় এল সাগ্নিকের হাত ধরে।



‘মাস্টার অংশুমান’ যখনকার কাহিনি, তাকে বর্তমান সময়ে তুলে ধরতে হলে পিরিয়ড পিস বানাতেই হতো। কারণ, সেখানে রহস্যভেদের কায়দা ও অন্যান্য ছোটোখাটো বহু বিষয়ই এখন পাল্টে গেছে, লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কাজেই, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই কাহিনিকে বাস্তবে আনতে গেলে তাকে আধুনিক করতেই হবে। সেই কাজটি যথাসাধ্য নিপুণভাবেই করার চেষ্টা করেছেন সাগ্নিক ও চিত্রনাট্যকার শ্রীপর্ণা মিত্র।

‘মাস্টার অংশুমান’-এর কাহিনি একটি সিনেমার শুটিংকে ঘিরে। অংশুমানকে তার কাকা বিশু একটি ছবির শিশু-অভিনেতা হিসেবে পরিচালককে (সুপ্রিয়) দেখালে তাঁর পছন্দ হয়। তিনি অংশুমান ও অন্যান্য অভিনেতাদের নিয়ে ছবি করতে দার্জিলিং রওনা দেন। শৈলশহরে যে বাড়িতে ছবির শুটিং হচ্ছিল, সেই বাড়ির মালিক মিঃ লোহিয়া রত্ন-সংগ্রাহক। তাঁর সংগ্রহে থাকা ব্লুবেল হিরেটি চুরি করার মতলব আঁটছিল বেশ কয়েকজন চোরাকারবারি। সেই উদ্দেশ্যেই তারা একজনকে সিনেমার দলের মধ্যে মোতায়েন করে। হিরেটি চুরিও যায়। অবশেষে অংশুমানের বুদ্ধিমত্তার জোরে ধরা পড়ে অপরাধী।

আরও পড়ুন:  রুক্মিণীতেই ভরসা রাখলেন বিরসা

ছবিটিকে সাম্প্রতিককালে আনতে গিয়ে পরিচালককে কাহিনির অনেক অংশই বদলাতে হয়েছে। তাই ছবিতে দেখানো সিনেমার কাহিনির কাঠামোটি বাদে বাকি খোলসের বেশিরভাগটাই পাল্টে দিতে হয়েছে। তবে মূল গল্পে যেখানে শুটিং হওয়ার কথা ছিল, তিনি সে জায়গার উল্লেখও অভিনেতাদের মধ্যে দিয়ে করিয়ে নিয়ে জানিয়েছেন, সে জায়গাটি তাঁর পছন্দ নয়। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মিঃ লোহিয়ার রত্নসিন্দুককে ডিজিটাল সিকিউরিটি দেওয়া হয়েছে। এরকম বদলগুলি যথেষ্ট প্রশংসনীয়। এছাড়া, মূল গল্পে থাকা অংশুমানের চোট পাওয়ার দৃশ্যটিকে সামান্য রদবদল করে দীর্ঘায়িত করে দেখানো হলেও তা আগে থেকে গল্প পড়ে থাকা দর্শকের ভালো লাগবে। একটি ছবি তৈরি করতে গেলে তা সবসময় নিখুঁতভাবে হয় না। অনেকসময় বারবার রিহার্সলের পরেও ভুলচুক রয়ে যায়। এই ধরণের ছোটোখাটো খুঁতখুঁতুনিগুলোকে ছবির পর্দায় দেখিয়ে পরিচালক বাহবা কুড়োতেই পারেন।

সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এই বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্যতে বহু জায়গায় সত্যজিৎভক্তরা ট্রিবিউট খুঁজে পাবেন। মন্দার বোসের ‘ভ্যানিশ’ বলা থেকে শুরু করে ফেলুদার বলা ‘কলকত্তা’ হোক, বা ‘জলসাঘর’-এর তুফান থেকে শুরু করে সুযোগ পেলেই সত্যজিৎকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সাগ্নিক। আবার ছবি দেখতে-দেখতে ফেলুদাপ্রেমী দর্শকরা ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ বা ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র রেফারেন্স পেয়েও উচ্ছ্বসিত হতে পারেন।

আরও পড়ুন: ঋত্বিক ঘটকের ভূমিকায় শিলাজিৎ

নব্য অভিনেতা হিসেবে স্যমন্তক (অংশুমান) প্রশংসনীয়। মূল কাহিনির তুলনায় ছবিতে অনেকটা বেশি জায়গা পাওয়ায় ক্যাপটেন কৃষ্ণণের ভূমিকায় সোমের অভিনয় চোখ টানে। শুরু থেকে থেকে শেষ পর্যন্ত আদ্যোপান্ত খলনায়কের চরিত্রে রজতাভ সম্পূর্ণ সফল। চরিত্রটি যে কেবলমাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রেই খল নয়, বরং তার ক্রিয়াকলাপ ও সাধারণ হাবভাব-চালচলনেও খলপ্রকৃতির, সে কথা প্রতি ফ্রেমে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। এছাড়া প্রিয়াঙ্কা, চঞ্চল যথাযথ। সুপ্রিয় ও দেবেশের  চিত্রনাট্যের বাইরে গিয়ে বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবু দুই বর্ষিয়ান অভিনেতা নিজেদের সেরাটুকু দিয়েছেন।

ছবির শুরুতে টাইটেল কার্ডে ‘মাস্টার অংশুমান’ কাহিনিতে সত্যজিৎকৃত অলংকরণগুলির ব্যবহার দেখতে ভালো লাগে। ধরম গুলাটি ও রানা দাশগুপ্তের ক্যামেরার কাজ চমৎকার। কয়েকটি ফ্রেমে মনে হতে পারে, দর্শক নিজেই দার্জিলিংয়ে উপস্থিত। সোমনাথ রায়ের আবহে সত্যজিৎকে ট্রিবিউট দেওয়ার পরেও তিনি তাঁর নিজস্বতা ধরে রেখেছেন। ক্যাপটেন কৃষ্ণণের স্টান্টম্যান হওয়ার কাহিনি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত গানটিকে অগ্নি রায় ও সাগ্নিক সযত্নে সাজিয়েছেন, যাতে মূল কাহিনি থেকে তা বিচ্যুত না হয়ে পড়ে। সেই গানটির জন্য সোমের কোরিওগ্রাফার তপস্যা দাশগুপ্ত বিশেষ প্রশংসার দাবিদার। সুজয় দত্তরায়ের সম্পাদনা যথাযথ।



তবু বেশ কিছু খারাপ লাগা থেকে যায়। চরিত্রগুলিকে বর্তমান সময়োপযোগী করে তুলতে গিয়ে বেশ কয়েকটির ভূমিকা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলানো হয়েছে। মূল উপন্যাসটি পড়া থাকলে বহু ঘটনার বাদ পড়ে যাওয়া চোখে লাগতে পারে। ছবির কাহিনিকে আধুনিক করা এবং সত্যজিতের প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে তাকে ইলাস্টিকের মতো টেনে বাড়ানো হয়েছে। দীপের (অরিত্র) মতো চরিত্র এই ছবিতে নতুন মোচড় আনলেও তার আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল না। ছবির দৈর্ঘ্য অনায়াসে আধঘণ্টা কমানো যেত। ক্লাইম্যাক্সের দুর্ঘটনাটি নিয়ে মূল কাহিনিতে একটি অলংকরণ ছিল, যা টাইটেল কার্ডেও ব্যবহার করা হয়েছে। তারপরেও পর্দায় তা অত্যন্ত দায়সারাভাবে এল। ছবির ঘটনাক্রম বর্তমান সময়ে আনা হলেও ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে ব্যবহৃত দুর্বল গ্রাফিক্স ষাটের দশকের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাছাড়া ছবির সমাপ্তি পর্বটিতে চিত্রনাট্যকার অতিরিক্ত আবেগের মশলা সংযোজন করতে গিয়ে দর্শকের মনে বিরক্তিরই উদ্রেক ঘটান।  

এতকিছুর পরেও বলা যায়, গরমের ছুটিতে ছোটদের জন্য ‘মাস্টার অংশুমান’ একটি গোছানো ছবি। মূল কাহিনি পড়া না থাকলে দর্শকের মনে অনেক খুঁতই দাগ কাটবে না। তবে প্রেক্ষাগৃহে বসে কিছুক্ষণের জন্য পাহাড়ভ্রমণ করে আসাই যায় ‘দার্জিলিং ধুন্ধুমার’ ছবির অভিনেতা ও কলাকুশলীদের সঙ্গে!




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *