বর্তমানের আয়নায় অতীতের প্রতিচ্ছবি
ছবি: শেষের গল্প
পরিচালনা: জিৎ চক্রবর্তী
অভিনয়ে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মমতা শংকর, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণকিশোর মুখোপাধ্যায়, পল্লবী চট্টোপাধ্যায়, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, দুর্গা সাঁতরা
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৩ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, “মূলতই ভালবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।” এ কথা সম্ভবত সেই আদি কবি কিংবা বিধাতাপুরুষও মানব জীবনের ভাগ্য লিখনের সময়েই রচনা করে গেছেন। প্রেমের সার্থকতা তো বিরহেই। একমাত্র তখনই সম্ভব হয় ছোট ছোট পাওয়া অথবা না পাওয়ার মুহূর্তগুলোকে হৃদয়ের গোপন কোণে সযত্নে লালন করার। যেই সে প্রেম মিলনের দরজায় কড়া নাড়ল, অমনি সমস্ত একান্ত মুহূর্ত, যত্নে রাখা ছোট ছোট রঙিন খুশির কোলাজ, আড়াল করে রাখা অভিমানী মৌনতা, সব কেমন যেন হাটের মাঝে এসে পড়ে। তখন তাকে আর নিজের করে রাখার তেমন চেষ্টা বা প্রয়োজন পড়ে না। মিলনের আনন্দে বাকি সব অনুভূতি কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যায়। তাই বলে কি মিলন অপ্রয়োজনীয় বা তার কোনও সার্থকতা নেই? নিশ্চয়ই আছে, কত নারী পুরুষের মিলনে আকাশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে প্রতিদিন। কিন্তু অমিত আর লাবণ্য, যাদের একে অপরের সমস্তটা জানা হয়ে গেলেও কোনও এক অদৃশ্য গন্ডি পেরিয়ে কিছুতেই যেন আর হাত ধরা হয়ে ওঠে না, অধিকারবোধ যাদের অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করতে পারে না, তাদের বোধহয় এক হতে নেই।
কী হত যদি মিতা আর বন্যা বিবাহের বন্ধনে এক হয়ে যেত? এমন কীই বা আর হত! শুধু হয়ে উঠত না একটা কালজয়ী উপন্যাস, রয়ে যেত না মানুষের মনে অমিত আর লাবণ্যর জন্য এক অব্যক্ত যন্ত্রণাবোধ। সমস্ত না পাওয়া প্রেমের কষ্টকে মনে পড়িয়ে দেয় যে মধুর সম্পর্ক, তাদের এক হয়ে গেলে চলবে কেন? তাই তো রবীন্দ্রনাথ তাদের বেঁধেছিলেন বন্ধনহীন গ্রন্থি দিয়েই, যে বাঁধন মিলনের দরজায় কড়া না নেড়েও সার্থকভাবে বেঁচে থাকে পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা দুটি মানুষের মধ্যে।
কেন এল অমিত ও লাবণ্যর এক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা? কারণ তাহলে পাওয়া যেত না এতদিন পরে হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে গিয়ে দুজনের মাঝের সময় থমকে যাওয়া অমূল্য নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকার ক্ষণকে, যে সংলাপহীন দৃশ্যে সমস্ত ‘শেষের কবিতা’টাই বাঁধা পড়ে যায়। পরিচালক হিসেবে জিতের প্রথম ছবি ‘শেষের গল্প’ এই অসাধারণ মুহূর্তগুলিকে ও শুধু দৃষ্টি দিয়ে একে অপরকে ছুঁয়ে দেওয়ার অনবদ্য রসায়নকে ধরে রেখেছে বড় সুন্দরভাবে। অমিত ও লাবণ্যর ভূমিকায় সৌমিত্র ও মমতা শংকর স্বাভাবিকভাবেই অপ্রতিরোধ্য। বিশেষ কিছু দৃশ্যে দুজনের পারস্পরিক বোঝাপড়া তাক লাগিয়ে দেয়।
স্বপ্ন দেখি, কলেজ ফেস্টে কেউ একদিন বাংলা খেয়াল গাইবে: সুমন
এঁদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন ইন্দ্রর ভূমিকায় কল্যাণ, নরেন্দ্র (কৃষ্ণকিশোর), নবকৃষ্ণ (খরাজ) ও শিশির (পল্লবী)। এঁরা প্রত্যেকেই অভিজ্ঞ শিল্পী হওয়ার দরুণ চিত্রনাট্যের ছোটখাটো ত্রুটি ঢেকে দিয়েছেন নিজগুণেই। তবে আকাশ ও কুহুর চরিত্রে অর্ণ ও দুর্গাকে কিছু কিছু জায়গায় বেশ আড়ষ্ট লেগেছে। এঁদের দৃশ্যগুলির ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের দুর্বলতা চোখে পড়েছে কয়েকবার। অমিত ও লাবণ্যর মতই গাড়ি দুর্ঘটনায় দেখা হয়ে যায় দুজনের, কিন্তু দুর্ঘটনার পরবর্তী তর্কাতর্কি খুব আরোপিত মনে হয়। তবে কিছু কিছু জায়গায় অর্ণর অভিনয় প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম। উপন্যাসের রেশ টেনে যোগমায়ার চরিত্রটি গল্পে আলাদা করে অক্সিজেন এনেছে।
আলাদা করে মনে থেকে যায় অমিত ও কুহুর নাচের দৃশ্যটি। ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রানেশ হে’ গানে লাবণ্যর নাচ ও অবশ্যই অমিতের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার প্রথম মুহূর্তটি মনে রেখে দেওয়ার মত। ভাল লাগে ‘বুড়োবুড়িদের মেস’-এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিশেষ করে তাঁদের দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার দিন বাস্তব জীবনের কদর্য রূপ মনকে নাড়া দিয়ে যায়। পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানে মিনিট খানেকের অভিনয়ে আরও একবার নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন খরাজ। বহুদিন বাদে কল্যাণকে এমন স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্রে দেখে ভালো লাগে। মেসের বোর্ডারদের মধ্যে বাঙাল ঘটির ঝগড়া একটু চড়া দাগের হলেও কিছু জায়গায় কমিক রিলিফ দিয়েছে। ছবির শেষে বন্যা ও মিতার মুখোমুখি আত্মকথন রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সুন্দরভাবে মেলে ধরে।
পুনরায় চালু হবে ইলোরা, জানিয়ে দিল মালিকপক্ষ
জয় সরকারের সুরে ছবির গানগুলি শ্রুতিমধুর। বিশেষ করে মনে থেকে যায় রূপঙ্করের গাওয়া ‘প্রাক্তন আজও অতীতের কাছে নতজানু হয়ে বাঁচে’ গানটি। ছবির শুরুতে সব্যসাচী চক্রবর্তীর নেপথ্য কণ্ঠে ‘শেষের কবিতা’র প্রেক্ষাপট বর্ণনা ছবির মূল সুরকে ধরে দিতে সাহায্য করে তাদের, যারা এ কাহিনীর ইতিহাস জানেন না।
সবশেষে বলাই যায়, অমিত ও লাবণ্যর চরিত্রে পরিচালকের নির্বাচন এর থেকে ভালো হতে পারত না। সৌমিত্র ও মমতা শংকর যেন চিরকালই এই দুই চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে এসেছেন, ‘শেষের গল্প’ শুধু তার এক্সটেনশন মাত্র। এত অজস্র চরিত্রে অভিনয়ের পরে দুজনের এতকালের তৈরি হওয়া ইমেজ সেই গল্পটাই যেন বলে যায়।