হস্টেজ থ্রিলারকে টেক্কা দিয়ে গেল কঠিন বাস্তব
ছবি: টেক্কা
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: দেব, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, রুক্মিণী মৈত্র, সৃজা দত্ত, আরিয়ান ভৌমিক, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, লোকনাথ দে, টোটা রায়চৌধুরী
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆
এই মুহূর্তে বাংলায় সবথেকে চর্চিত আর চেনা শব্দ ‘দুর্নীতি’। সমাজের অলিগলি রাজপথ ঘুরে ক্ষমতার অলিন্দে যে শব্দ স্থায়ী বসবাস করতে শুরু করেছে এবং যাকে অনেকাংশে বাঙালি নিজের ভবিতব্য বলে মেনেও নিয়েছে, সৃজিতের (Srijit Mukherji) সাম্প্রতিক ছবির ভিতও তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই।
ছবির কাহিনি ট্রেলারেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাদের স্কুলের সামনে থেকে ইখলাক আলম (দেব) নামে একজন সাফাইকর্মী একটি বাচ্চা মেয়েকে অপহরণ করে। এক হাতে আগ্নেয়াস্ত্র এবং অন্য হাতে বাচ্চাটিকে নিয়ে একটি বহুতল অফিস বিল্ডিংয়ে গিয়ে সে আশ্রয় নেয়। কেসের দায়িত্ব নিয়ে এসিপি মায়া খাস্তগীর (রুক্মিণী) কিছুটা দূরত্ব রেখে ইখলাককে ধীরে-ধীরে প্রশ্ন করতে থাকে। জানা যায় আগের দিনই তার চাকরি গেছে। সে তার চাকরি ফেরত চায়।
ওদিকে বাচ্চাটির মা ইরা (স্বস্তিকা) পুলিশকে অনেক অনুরোধ করেও কোনও সুরাহা না হওয়ায় বেপরোয়াভাবে ইখলাকের ছেলেকে তার বাড়ি থেকে তুলে আনে। এবার কী হবে? একদিকে পরিস্থিতির চাপে পড়ে দিশেহারা হয়ে যাওয়া এক সমাজবিরোধী, অন্যদিকে সন্তানকে ফিরে চাওয়া দুই পক্ষে একজন করে অসহায় মা ও বাবা। কে আগে অস্ত্র ফেলবে?
আরও পড়ুন: ১৪ বছর পর প্রিয়দর্শনের ছবিতে অক্ষয় কুমার
না, ‘টেক্কা’য় (Tekka) পুজোর ছবির মতো জমজমাট আনন্দ, আহ্লাদ, খুশি-খুশি ভাব কোনওটাই নেই। ছবি দেখে বেরিয়েও সেই ফিল গুড পুজোর আমেজ আসবে না। তবে এমনটাই হয়তো হওয়া উচিত। এই মুহূর্তে চারপাশে যে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাকে এড়িয়ে, ভুলে গিয়ে ভালো থাকার নাটক করার কোনও মানে হয় না। প্রত্যেকটা মানুষ জানে যে কোনওদিন এই দুর্নীতির পাহাড়ে সেও আটকে পড়তে পারে। যা আজ একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে হচ্ছে কাল, আমার সঙ্গেও হতে পারে, এ কথা সবার জানা। কিছু লোভী, অর্থপিশাচ, বেপরোয়া মানুষের জন্য সারা দেশ আজ ডুবতে বসেছে। তবু থামে না কোনও কিছুই। যতক্ষণ না সিস্টেমের মূল ধরে নাড়া দেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ চলতে থাকে অপরাধ, অরাজকতা। সেই পচে যাওয়া সিস্টেমকে দেখে আমরা প্রতিদিন শিউরে উঠি, ঘেন্নায় মুখ ফেরাই। তবু এগিয়ে আসি না পরিশোধনের কাজে। সেই কাজের জন্যই এগিয়ে আসতে হয় সাফাইকর্মী ইখলাকের মতো মানুষদের, হোক না সে সিনেমার পর্দায়।
সৃজিতীয় সূত্র মেনে ছবিতে টুইস্ট থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। তাই শেষে ক্লাইম্যাক্স চমকে দেবার মতো হলেও আতঙ্কিত করে এই ভেবে যে কোথায় বাস করি আমরা! এমনই তো হয়ে চলেছে প্রতিদিন আমাদের চোখের আড়ালে। কিছু খবরে উঠে আসে, বেশিরভাগটটাই আসে না। যদিও সেই খবরও কীভাবে পেশ করা হয়, কতটা নির্মমতা লুকিয়ে থাকে ‘ব্রেকিং নিউজ়’ নামক শব্দবন্ধের আড়ালে তাও দেখিয়েছেন সৃজিত।
আরও পড়ুন: পরিবারের নতুন সদস্য জয়দীপ
তবে কিছু জায়গায় আর একটু সতর্কতা অবলম্বন করা যেত। যেমন অনুব্রতবাবুকে (পরান)কোথাও বলা হচ্ছে তিনি শিল্পপতি, ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, কোথাও আবার বলা হচ্ছে তিনি রাজনীতিবিদ। এরকম সামান্য কিছু জিনিস নিয়ে আর একটু সতর্ক হওয়া যেত। যেমন বাংলা চ্যানেলের সমস্ত অতিথিই কেন ইংরেজিতে আলোচনা করেন বোঝা যায় না।
দেবকে (Dev) এই ছবিতে নতুন করে আবিষ্কার করা যাবে। পুরোপুরি চরিত্রে ঢুকে গিয়ে এতটা সাবলীল এবং স্বাভাবিক হয়ে ওঠা সহজ ছিল না। পেরেছেন তিনি। এতটুকু অতিঅভিনয় করেননি কোনও ফ্রেমে। অসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে ইখলাক আলম। প্রত্যাশিতভাবেই অসাধারণ স্বস্তিকা (Swastika Mukherjee)। যদিও তাঁর জন্য সুযোগ কিছুটা কমই ছিল। সবথেকে বেশি সুযোগ ছিল রুক্মিণীর (Rukmini Maitra)। চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে চারিত্রিক ম্যানারিজ়ম কিছু জায়গায় চোখে লাগে।
আরও পড়ুন: ২০ বছর পর নতুন নজির ‘বীর জ়ারা’র
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েসুছে ছবির গতি। টানটান থ্রিলার গল্পে যেমনটা হওয়া উচিত সেভাবেই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন পরিচালক। কোথাও কোনও হালকা সুতো ছাড়া হয়নি যা গল্পের গতিকে প্রতিহত করে। সৃজা (Sreeja Dutta) এবং আরিয়ান (Aryann Bhowmik) দুজনেই বাস্তবের চরিত্র হয়ে উঠেছে। স্বল্প পরিসরে লোকনাথ (Loknath Dey) একেবারে আসল পুলিশের মতোই। ছোট চরিত্রে পরান (Paran Bandopadhyay) বরাবরের মতোই উজ্জ্বল। সুজনের অভিনীত চরিত্রটি ভাবতে বাধ্য করে আমরা রোজ যা দেখি আর বাস্তবে যা ঘটে তার মধ্যে তফাৎ আসলে কতটা! চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গিয়েছেন তিনিও।
ছবিতে গানের প্রয়োজন সেভাবে না থাকলেও রণজয় ভট্টাচার্যর (Ranajoy Bhattacharjee) সুরে অনুপম রায়ের গলায় ‘তোমায় ছেড়ে যেতে পারলাম কই’ শুনতে ভালো লেগেছে। মধুরা পালিতের চিত্রগ্রহণ ঝকঝকে এবং যথোপযুক্ত। প্রণয় দাশগুপ্তের সম্পাদনা ছবিকে কোথাও একঘেয়ে লাগতে দেয়নি। সোয়া দু’ঘন্টার ছবিতে কোথাও উত্তেজনায় রাশ টানতে হয়নি। দীপ্তার্ক বসুর আবহ ছবির সঙ্গে মানানসই।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ রহস্য গল্পের চেয়ে বাস্তবকেন্দ্রিক থ্রিলারকে বেছে নিয়েছেন সৃজিত যা সত্যিই দর্শককে ভাবতে বাধ্য করবে। তাঁর সাম্প্রতিক অনেক থ্রিলার ছবিকে ছাপিয়ে গিয়েছে ‘টেক্কা’র চিত্রনাট্য। বর্তমান সময়ের নিরিখে এমন এক টানটান উত্তেজনার ছবি বহু মানুষকে ভাবাবে, কাল্পনিক এক গল্প দিয়ে যে থ্রিলার প্লট গড়ে তুলেছেন কাহিনিকার ভাস্কর (চট্টোপাধ্যায়) ও সৃজিত তা যে কোনওদিন সত্যি হয়ে উঠতে পারে আমাদের জীবনে। যত দিন যাচ্ছে সমাজের মাথারাই তেমন একটা দিন দেখতে আমাদের বাধ্য করছেন।