মেজাজটাই তো আসল রাজা, আমি রাজা নয়
ছবি: কেদারা
পরিচালনা: ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত
অভিনয়ে: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, বিদীপ্তা চক্রবর্তী
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৪ মিনিট
RBN রেটিং: ৪/৫
ইন্দ্রদীপের ‘কেদারা’ দেখার পর একটা গানের কলি মনে আসতে বাধ্য, ‘মেজাজটাই তো আসল রাজা, আমি রাজা নয়’। মেজাজ যে একজন সাধারণ শান্ত নির্বিবাদী মানুষকে সিংহে পরিণত করতে পারে, তার নমুনা হলেন নরসিংহ। বাবা মা মারা যাওয়ার পর ঠাকুমাকে আঁকড়ে ধরে জীবন শুরু হয় নরসিংহের। ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে সে চিনতে শুরু করে আকাশে কোনটা কালপুরুষ আর কোনটা সপ্তর্ষিমন্ডল। তাই তো ঠাকুমার মৃত্যুর পরেও নরসিংহের দিন শুরু হয় সেই বৃদ্ধার হাতের চা-মামলেট খেয়ে।
এখানেই চমকে যান দর্শক। মানসিকভাবে অত্যন্ত একা নরসিংহ আসলে স্বভাবে হরবোলা। তাই বাড়িতে একা থাকার সময় শৈশবে বিরাজ করতে থাকে এই মানুষটি । নিজের সঙ্গেই বিভিন্ন গলায় কথা বলে তিনি প্রমাণ করতে চান তার পারিপার্শ্বিকে ঠাকুমা, বুনিমাসির উপস্থিতি। নিজের একার সংসারে বাজার করতে গিয়ে মাছের দরদাম করেও শেষমেশ একটা রূপচাঁদা কিনেই ক্ষান্ত হন। বাজার থেকে ফেরার পথে পাড়ার ছেলেদের কাছে খোরাক হন। চুপ করে ঘরে ফেরেন নরসিংহ।
ভিড়ের মধ্যেও ভীষণ একা মানুষ এই নরসিংহ। স্ত্রী, সন্তান তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এই দুনিয়ায় তার বন্ধু বলতে পাড়ার পুরোনো জিনিস বিক্রেতা কেষ্ট। লোভ, লালসা, কাম কোনওকিছুই নরসিংহকে অমানুষ বানায় না। একা থাকতে থাকতে তিনি নিজেই তার লোভ সংবরণ করতে শিখে যান, শিখে যান কাম নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন মানুষের গলা থেকে শুরু করে পশুপাখির ডাক নৈপুণ্যের সঙ্গে নকল করতে পারা নরসিংহকে লোকজন শুধু হরবোলা বলে মজা করে যায়। কোথাও যেন মরতে থাকে তার শিল্পীসত্বা।
আরও পড়ুন: খেল দিখা সকোগে না?
সারাদিন একই ভাবে চলতে থাকা নরসিংহ ভুলেই যান তিনি প্রতিবাদ করতে জানেন। তবুও একদিন গর্জে ওঠেন তিনি। পুরোনো এক জমিদারবাড়ি থেকে কেষ্ট তার জন্য নিয়ে আসে একটা বিশাল কেদারা ও আয়না। সেই কেদারায় সওয়ার হয়ে নরসিংহের অন্তরের সিংহ জেগে ওঠে। এক অদ্ভুত মেজাজ ফিরে পান তিনি। তাকে প্রতিনিয়ত অপমান করা প্রত্যেকটি মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পিছপা হন না আর। রাজনৈতিক গুন্ডাদের হাত থেকে নিজের বাড়ির বারান্দাটি বাঁচাতে গিয়ে নরসিংহ মুখোমুখি হন এলাকার বিধায়কের সঙ্গেও। ফলত নিগৃহীত হতে হয় তাকে।
নরসিংহের চরিত্রে কৌশিক সম্পর্কে কোনও বিশেষণই যথেষ্ট নয়। একজন সংবেদনশীল মানুষের মনের একাকীত্বকে তিনি ফুটিয়ে তুললেন প্রতিটি ফ্রেমে। বিভিন্ন গলায় বিভিন্ন মানুষের চরিত্রে যখন কথা বলছেন তখন তাঁর মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন আবারও প্রমাণ করল কৌশিক এসময়ের একজন অন্যতম সেরা অভিনেতা। একজন শিল্পীই তো অপর একজন শিল্পীর চরিত্র নির্মাণে সক্ষম হবেন।
কেষ্টর চরিত্রে রুদ্রনীল অনবদ্য। তার সঙ্গে নরসিংহের ছোটছোট দৃশ্যে দুই দাপুটে অভিনেতার টক্কর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতো। স্বল্প পরিসরে বিদীপ্তা যথাযথ। ইন্দ্রদীপের ভাবনাকে কথা দিয়ে অত্যন্ত যত্নসহকারে বুনেছেন শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছবির সংলাপ তাঁর লেখা। অরিজিৎ সিং তাঁর প্রথম সঙ্গীত পরিচালনায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হলেন। অযথা একগাদা মিউজ়িক্যাল এক্সপেরিমেন্টে না গিয়ে নিজস্ব সুরের আবহ তিনি ছড়িয়ে দিলেন ছবিতে।
আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
দূর্দান্ত এক সাউন্ডস্কেপ রচিত হয়েছে গোটা ‘কেদারা’ জুড়ে। চায়ের কাপের শব্দ, খবরের কাগজের পাতা ওল্টানোর শব্দ, এমন কি মাছির ভনভনানিও নরসিংহের একাকীত্বকেই সংগত করে। আবার রেডিওতে ‘রাত কলি এক খোওয়াব মে আই’ শুনে নরসিংহ কল্পনায় দেখতে থাকেন তার স্ত্রীর স্নানের দৃশ্য। শব্দ নিয়ে কিছু কিছু জায়গায় অসাধারণ খেলেছেন অনির্বাণ সেনগুপ্ত।
‘কেদারা’ একটি দৃশ্যকাব্য। একাকীত্বে ভুগতে থাকা একটি মানুষের চোখ দিয়ে বিভিন্ন কল্পদৃশ্যের মায়াঘেরা সংসার এই ছবি। যে তালাবন্ধ ঘর খুলে নরসিংহ আগে কল্পনায় আকাশভরা তারা দেখতে পেতেন, সেই ঘর যখন শেষ দৃশ্যে খোলা হলো তখন সেখানে শুধুই মাকড়সার ঝুল। ‘কেদারা’র মাস্টারস্ট্রোক হয়ে থাকবে এই দৃশ্যটি। প্রথম ছবিতেই দর্শকদের মন জয় করলেন পরিচালক। যেমন টানটান চিত্রনাট্য, তেমন চরিত্ৰ নির্বাচন, তেমনই ছবির চিত্রগ্রহণ। সাহসিকতার পরিচয় দিলেন ইন্দ্রদীপ। এই ছবি মনে রেখে না দিলে তা স্মৃতিভ্রমেরই নামান্তর।