যেন প্রেমকে জিতিয়ে দিতেই হবে
ছবি: চিনে বাদাম
পরিচালনা: শিলাদিত্য মৌলিক
অভিনয়ে: যশ দাশগুপ্ত, এনা সাহা
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট
RBN রেটিং: ২.৫/৫
আজকের যুগে, অন্তত শহুরে সভ্যতায় প্রায় সবাই একাকীত্বে ভোগে। নিজের জায়গায় একা প্রতিটি মানুষ খুঁজে বেড়ায় এমন কাউকে যাকে মন খুলে বলা যাবে সুখ দুঃখের সাতকাহন। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তেমন বন্ধু কিংবা মনের মানুষ? বর্তমান পৃথিবীর সর্বগ্রাসী প্রযুক্তি কি খুঁজে দিতে পারে তেমন কাউকে?
এ ছবির কাহিনী তেমনই এক প্রযুক্তিকে নিয়ে। দু’বছর পরে দেশে ফিরেছে ঋষভ (যশ)। ছেলে পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করবে, তারপর হইহই করে তার বিয়ে দিয়ে ফুটফুটে বৌমা ঘরে আনবেন, এমনটাই ইচ্ছে ছিল ঋষভের বাবা-মায়ের। কিন্তু ছেলে চায় স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে। তাই সে ঠিক করে একটা অ্যাপ বানাবে। ওই যেমন ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে দেখা না করেও যোগাযোগ রাখা যায়, সেরকমই কিছু।
এদিকে ঋষভের বিশেষ বান্ধবী তৃষা (এনা) একটা চাকরির চেষ্টা করছে। ঋষভ তাকে নিজের ব্যবসায় অংশীদার হতে উৎসাহিত করে। ইন্টারভিউ নিয়ে তৈরি করে নিজেদের টিম, তৈরি হয় অফিস, যাত্রা শুরু হয় ‘চিনে বাদাম’-এর।
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান
কিন্তু এত নাম থাকতে ‘চিনে বাদাম’ কেন? পার্কে পাশাপাশি বসে চিনে বাদাম ভাগ করে নেওয়ার মজা এক যুগে ছিল। এখন তো মানুষ একে অপরের সঙ্গে দেখাও করে না, সব যোগাযোগ ওই ফোনে আর নানা ধরণের অ্যাপে। এছাড়া সর্বজ্ঞ গুগল তো আছেই, তাই সব তথ্য হাতের মুঠোয়। সেই পুরনো ভালোলাগার মুহূর্তগুলো ফিরিয়ে আনতেই অ্যাপের নামকরণ করা হয় ‘চিনে বাদাম।’
সে না হয় হলো, কিন্তু আত্মীয়স্বজন যদি জানতে চায় জামাই কী করে! তখন কি বলা হবে ‘চিনে বাদাম’ বেচে? এ নিয়ে ঋষভের হবু শাশুড়ি মস্করা করতে ছাড়েন না। এদিকে পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে ‘চিনেবাদাম’-এর বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। দিলীপ বাজাজের মতো কুচক্রী তো শুরু থেকে ছিলই, পাশাপাশি সময়ও যেন ঋষভের শত্রু হয়ে ওঠে। তৃষার সঙ্গে বিচ্ছেদ, তার অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে ঋষভের মন অস্থির হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে সে কী করবে? ‘চিনে বাদাম’ কি তাহলে শেষ হয়ে যাবে? তৃষা কি চিরতরে হারিয়ে যাবে ঋষভের জীবন থেকে?
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
শিলাদিত্যের পরিচালনায় এ ছবিতে যশ ও এনা ছাড়াও আছেন টেলিভিশনের বহু পরিচিত শিল্পী। পাশাপাশি এ ছবিতে অভিনয় করেছে একঝাঁক নতুন মুখও। বলা বাহুল্য ছবির ভাবনাটিও বেশ নতুন। মানে এই সময় চারদিকে ঠিক যেমনটা হচ্ছে, একাকিত্ব দূর করতে মানুষ নিজের মতো করে বাঁচার পথ খুঁজে নিচ্ছে। আসলে ‘চিনে বাদাম’ হলো বন্ধুত্বের অ্যাপ। এই অ্যাপে একজন একা মানুষ অন্য একটি মানুষকে পাশে চাইবে, তার নির্দিষ্ট কারণের বর্ণনা অ্যাপে নথিভুক্ত করে। অন্য মানুষটি হতে পারে পুরুষ বা মহিলা। আর যদি নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনও সমস্যা তৈরি হয়, অ্যাপ থেকে সরাসরি ফোন চলে যাবে পুলিশের কাছে।
এত কর্মকান্ড সামলানো তাও আবার একটা অ্যাপ দিয়ে যথেষ্ট কষ্টকর, আর সেভাবে কিছুটা কষ্ট করেই এগিয়ে চলে চিত্রনাট্য।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
ছবির শেষে এসে মনে হয় ‘হারিয়ে যাও যদি ভিড়ে’ গানটির সার্থকতা কিছুটা যেন চরিতার্থ হয়। এর আগে প্রেম কখনও সাবলীলভাবে, কখনও অস্তিত্বের লড়াইয়ে, কখনও বা পরিণত দৃষ্টিকোণে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পরিচালকের ছোঁয়ায়। সেক্ষেত্রে ‘চিনে বাদাম’-এ যেন প্রেম বা বন্ধুত্বকে জিতিয়ে দিতেই হবে, কেউ এমনটা বাজি রেখেছিল বলে মনে হয়। অন্তত তৃষার হঠাৎ করে অন্যত্র বিয়েতে রাজি হওয়া, আবার জীবনের এক বিশেষ দিনে নতুন করে বন্ধু খোঁজার দৃশ্যগুলো ছবির গল্পের বুনোটকে আলগা করেছে নিঃসন্দেহে। কেমন যেন আগে থেকেই সব ঠিক করে রাখা ছিল।
প্রেমের ছবির নায়ক হিসেবে যশের কাছে দর্শকের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ক্লাইম্যাক্সে ভিলেনের চোয়াল ভাঙা আর প্রেমে ও ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে অফিসের আসবাবপত্র ভাঙচুর করার অভিব্যক্তি যে কখনও এক হতে পারে না, অন্তত এবার তাঁর বোঝা উচিত। এনাকে বেশ কিছু দৃশ্যে মিষ্টি লেগেছে, তবে ওইটুকুই।
আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ
শিলাদিত্যের ছবি মানেই দর্শকের বড় আশার জায়গা। সে জায়গা শিলাদিত্য পেয়েছেন নিজ গুণেই। দর্শকের সেই প্রত্যাশা পূরণে ছবির চিত্রনাট্যে অনেক বেশি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন ছিল। নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে মানুষ, এটা আজ বাস্তব। সেটা করতে গিয়ে মানুষ বিপদের সম্মুখীনও হচ্ছে। সেই বাস্তবতার চিত্র আরও বেশি প্রয়োজন ছিল ছবিতে।
সৌম্য ঋতের সুরে গানগুলি এ ছবির অন্যতম প্রাপ্তি। নচিকেতা চক্রবর্তী, অনুপম রায়, মেখলা দাশগুপ্ত ও বনি চক্রবর্তীর গলায় প্রতিটি গানই শুনতে ভালো লাগে। বিশেষ করে কাশ্মীরের বরফঘেরা সবুজ পাহাড়ে ‘হারিয়ে যাও যদি ভিড়ে’ গানটির দৃশ্যায়ন মন ছুঁয়ে যাবে। সেই মুহূর্তে যেন হারিয়ে যাওয়া মন ফিরতে চাইবে ছেড়ে আসা পথের বাঁকে।