‘বাঁধ ভাঙার দায়িত্বটা না হয় আমরাই নিলাম’
সমাজ যখন তার সংকীর্ণ ধ্যানধারণাকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জনের পথে পাড়ি দেয়, তখনই কিছু মানুষ যেন এক ক্ষীয়মান আলোর মত বাঁচিয়ে তোলে তাকে। নন্দিনী ভৌমিক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সংস্কৃত অধ্যাপনার পাশাপাশি নন্দিনীর আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি মহিলা পুরোহিত। নন্দিনী তাঁর লড়াইয়ে সফল কিনা তা হয়ত এখনই বলার সময় আসেনি, তবে মানুষ তাঁকে ভালোবাসছে, তাঁর বক্তব্যকে বুঝতে পারছে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ ছবি সেই লড়াইয়েরই গল্প বলে। কিন্তু হঠাৎ করেই এরকম একটি পেশাকে বেছে নিলেন কেন তিনি? রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নন্দিনী।
ছবি মুক্তির পর ব্যস্ততা কিরকম উপভোগ করছেন?
ভীষণ ভালো লাগছে। যে কাজের সঙ্গে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জড়িয়ে আছে সেটা যখন এভাবে বড়পর্দায় দেখতে পাই, তখন এক অসম্ভব তৃপ্তি হয়। খুবই আনন্দ হচ্ছে।
আপনি তো চেয়েছিলেন একদিন আপনার এই কাজ সর্বসমক্ষে আসুক?
হ্যাঁ, অবশ্যই। মনের দরজা খোলার তো প্রয়োজন ছিল। নাহলে তো সব ‘তাসের দেশ’ হয়ে যাবে। বাঁধ ভাঙার দায়িত্বটা তো কাউকে নিতে হবে। সেটা না হয় আমরাই নিলাম।
ছোটবেলা থেকেই কি পূজার্চনার দিকে ঝোঁক?
সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি একটা অনুরাগ তো ছিলই। আমার বাবা ছিলেন গৃহীসন্ন্যাসী। বাবার কাছ থেকেই আমি পুজোর সমস্ত কাজ হাতেকলমে শিখেছি। যজ্ঞ করা, যে কোনও পৌরহিত্যের মন্ত্রের যৌক্তিক ব্যাখ্যা করা, এসবই বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন। আর তুমি যে পূজা অর্চনা বা নিয়মের কথা বলছ, সেটা তো পুরোটাই পড়াশোনা। আমার সমস্ত পড়াশোনাটাই সংস্কৃত নিয়ে। এখনও আমি ভারততত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছি। যত পড়ব তত জানতে পারব। না পড়লে বুঝব কী করে? আমাদের ধর্মীয় আচার আচরণের মধ্যে আমি যদি একটু মানে খুঁজে দিতে পারি, বুঝিয়ে দিতে পারি, তাহলে তো জিনিসটা অনেক সহজ হয়। না বুঝে পুজো করব কেন?
আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল
পড়তে গিয়ে কখনও মনে হয়নি এতদিন ধর্মের নামে যা চলে আসছে আসলে এসবই মিথ্যাচার?
না, মিথ্যাচার বলব না। এই নিয়মগুলো যখন তৈরী হয়েছিল সেই সময়টার মধ্যে আমি থাকিনি। তাই আমার বলা উচিতও নয় যে সেই সময় সব ভুল ছিল, সব অন্যায় হয়েছিল। তবে এটুকু বলতে পারি, তখনকার অনেক কিছু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আর প্রযোজ্য নয়। সুতরাং আমরা আমাদের মতো করে আচার পালনগুলোর পরিবর্তন করে নিতে পারি। আর পরিবর্তন তো সবসময় কাম্য। সেটা ধর্মীয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
যখন পাকাপাকিভাবে পৌরহিত্যের কাজ শুরু করলেন তখন কিরকম বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়?
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সেভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। কখনওই কোনও প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের বিজয় লাভ করতে হয়নি। এটা বলতে পারি যে প্রথম-প্রথম মহিলা পুরোহিতদের লোকে আমন্ত্রণ জানাতো না। তবে এখন একটা জোয়ার এসেছে।
আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন
তার মানে এখন মানুষ বুঝতে শিখছে?
হ্যাঁ। আবার এটাও হতে পারে যে আমরা মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। আগে হয়তো আমাদের বোঝানোতে কোনও খামতি ছিল। চলার পথে বুঝতে পেরেছি কিভাবে বোঝালে তবে সবাই বুঝবে। মানুষের মনের কাছে পৌঁছতে হবে, এখনকার মত করে। তখনই সবাই সেই নতুনকে আপন করতে পারবে।
‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’তে শবরী তো আপনারই প্রতিরূপ। শবরীর মতো আপনার এই পেশার কারণে বৈবাহিক জীবনে কোনও সমস্যা হয়নি?
এই ছবিটি কিন্তু কোনওভাবেই আমার বায়োপিক নয়। শুধুমাত্র মহিলা পুরোহিতদের এই দীর্ঘ পথ অতিক্রমের লড়াইটা তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিতে। তবে এটা বলতে পারি, আমরা সবাই কিন্তু বিয়ের পর একটি রক্ষণশীল পরিকাঠামোর মধ্যেই জীবনযাপন করেছি। এটাই স্বাভাবিক। কারণ সমাজটা তো একসময় এরকমই রক্ষণশীল ছিল। ক্রমশ যখন আগলটা হালকা হতে শুরু করল তখন আমাদেরও সাহস বাড়তে লাগল। আসলে এই সবকিছুর পিছনে রয়েছে পড়াশোনা। জানতে হবে, পড়তে হবে।
আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে
আপনারা শ্রাদ্ধশান্তির সময় পিন্ডদান করেন না। আপনি বলেছেন মৃত্যু শোক নয়। তাহলে আপনার কাছে মৃত্যুর সংজ্ঞা কী?
মৃত্যু শোক কেন হবে? মৃত্যু তো উত্তরণের পথ। বেদ, উপনিষদ, ভগবৎ গীতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এদের হাত ধরে আমরা যেভাবে মৃত্যুকে অনুধাবন করেছি, ঠিক সেভাবেই শ্রাদ্ধের কাজের আয়োজন করি আমরা। গীতাতে বলা আছে, জন্মান্তর যেন একটি বস্ত্র ছেড়ে অন্য আরেকটি বস্ত্রের পরিধান। অর্থাৎ মৃত্যুর পর তার আত্মাটা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সকলের মধ্যে যদি সেই পরমাত্মা থেকে থাকে, তাহলে তো শোক করার কোনও জায়গাই নেই। সবসময় মনের মধ্যে আনন্দকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাহলে সবকিছুতেই একটা পজিটিভ ফিলিং আসে।
পৌরহিত্যের নিয়মে রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে মেলালেন?
রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমরা কোনও অনুষ্ঠানই করি না। সমস্ত বেদ উপনিষদের নির্যাসটুকু রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে ভীষণভাবে পাওয়া যায়। তাঁর গান মন্ত্রের পরিপূরক। আমাদের অনুষ্ঠানে একটি মন্ত্রপাঠের পর একটি করে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন হয় এবং এভাবেই চলতে থাকে।
এর ফলে বিবাহের নিয়মপালনের ক্ষেত্রে তো সময় বেশি লাগা উচিৎ
না, কোনওভাবেই না। আমরা শুধু প্রধান নিয়মগুলি রাখি, ফলে সংক্ষেপে হয়।
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
আপনাদের নিয়মে তো কন্যাদান প্রথাও নেই। সেটার কি ব্যাখ্যা?
কোনওরকম বৈষম্যমূলক নিয়ম আমরা পালন করি না। বেদে কন্যাদানের উল্লেখ নেই। তবে বেদ-পরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে যে মেয়ের বাবা তার হবু জামাইকে বলছেন, শাড়ি গয়না দিয়ে কন্যাকে ঢেকে দিলাম, তুমি দয়া করে আমার এই দান গ্রহণ করো। এটার কী কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে? মেয়েরা তো পণ্য নয় যে তাদের দান করে দিতে হবে। আজ তো মেয়েরাও ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিশ্রম করছে, সমান উপার্জন করছে। এরকম কিছু নিয়ম আমরা বাদ দিয়েছি। আরও একটা বিষয়, বৈদিক বিবাহের নিয়মে বউয়ের বিশেষ কোনও ভূমিকা থাকে না। তারা শুধু বসে থাকে। কারণ আগেকার দিনে ছোট-ছোট মেয়েদের বিয়ে হত। তারা লেখাপড়া বিশেষ জানত না, তাই তাদের কিছু করারও ছিল না। আমাদের পদ্ধতিতে তা হয় না। এখানে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে মন্ত্র পাঠ করে, নিয়ম পালন করে। আসলে সবটাই সাম্যটুকু বজায় রাখার চেষ্টা।
ঋতুমতী নারীর পূজার্চনার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই, এই সত্য এখন সর্বজনবিদিত হলেও সর্বজনগৃহিত হয়নি। আপনি নিজেই এই অচলায়তনের নিয়মব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আপনার ছোটবেলায় এধরণের কোনও নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হতে হয়নি?
হ্যাঁ, হয়েছে। আমরা তো এইসব নিয়মের মধ্যে দিয়েই জীবন শুরু করেছি। তখন তো আমরাও ছোট, তাই সব মানতে হয়েছে। তখন ওইভাবে গুরুজনদের মুখে-মুখে তর্ক করাটাই অনুচিত ছিল। তারা তো তাদের একটা বিশ্বাস থেকে বলছেন, তাই তাদের অসম্মান করব কিভাবে? তারপর যখন বড় হলাম, পড়াশোনা করলাম, যুক্তি দিয়ে বোঝালাম, তখন দেখলাম তাঁরা সেই ভুল বুঝতে পারছেন। এটাই তো দরকার।
আপনার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই কাজের প্রতি অনুরাগ দেখছেন?
হ্যাঁ, ভীষণভাবে। যুক্তিবাদী মন যুক্তি দিয়ে বোঝালেই বুঝতে চাইবে।
তা সত্বেও আমাদের সমাজে সেভাবে মহিলা পুরোহিতদের সংখ্যা বাড়ছে না কেন? তাহলে কী এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা থেকে বেরোতে পারছে না কেউ?
না, তা বলব না। আসলে সাহসটা কাজ করছে না সবার মধ্যে। তবে এই যে ছবিটা মুক্তি পেল, এটা একটা জায়গা করে দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সাহসের সঞ্চারও ঘটবে। আর কিছুই না, এরপর মেয়েরা ঘরের লক্ষ্মী, সরস্বতী, এই পুজোগুলো তো নিজেরাই করতে পারবে। তার জন্য আর পুরোহিতদের প্রয়োজন হবে না।
ছবি: প্রতিবেদক