‘আমার মুখটাই একটা প্রশ্নচিহ্ন’
কলকাতা: “সহানুভুতির একটা ট্যাগ লাগানো আছে আমার মুখে। লোকের কৌতুহল তো হবেই,” এমনটাই বললেন মনীষা পৈলান। ২০১৫-এর নভেম্বর মাসের এক সকালে অ্যাসিডের হল্কায় জ্বলে গেছিল তাঁর মুখ, চোখ, কান। কিন্তু জ্বালাতে পারেনি তার অন্তরকে, ম্লান করতে পারেনি তার ঝলমলে হাসিকে।
সেই সোনার হাসির কয়েক টুকরো তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন গতকাল শহরে একটি অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে কলকাতায় এসেছিলেন অ্যাসিড আক্রান্ত মনীষা। নিজের সম্পর্কে বলতে উঠে প্রথমেই জানালেন, আক্রান্ত মেয়েদের যেভাবে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে, তার থেকে নিজেদেরকেই বেরিয়ে আসতে হবে। এরকম একটা ঘটনা যখন ঘটে তখন না চাইতেও মানুষের সহানুভুতির পাত্র হয়ে যেতে হয়।
দেবতার গ্রাস
মনীষার নিজের কথায়, “সেভাবে দেখলে আমারা সবাই আক্রান্ত। ক্ষত তো শুধুমাত্র অ্যাসিড থেকে হয় না। সকলের ভেতরেই কোনও না কোনও ক্ষত রয়েছে। বাকিদেরটা শুধু আমার মত দেখা যায় না, এটুকুই যা তফাত।”
শারীরিক ক্ষতকে গুরুত্ব দিতে নারাজ মনীষা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও বরাবর চেয়েছেন পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করে বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে। কিন্তু সমাজ তো সব স্বপ্ন এত সহজে সত্যি হতে দেয় না। এক আত্মীয়ের ছেলে মনীষার অনিচ্ছাসত্বেও তার সঙ্গে জোর করে বিয়ে করে। সেই না জেনে সই করিয়ে নেওয়া কাগজকে যখন মনীষা বিয়ে বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন তখন এক সকালে শাস্তি স্বরূপ তার ওপর নেমে আসে প্রাণঘাতী অ্যাসিডের আঘাত। চামড়াটা নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে একটি চোখও। তবু দমাতে পারেনি অদম্য প্রাণশক্তির আধার এই তরুণীকে।
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে ঝলমলে হাসিতে মনীষা বললেন, “আমার মুখটা তো মুখ নয়, একটা প্রশ্নচিহ্ন । কিন্তু লোকে যখন বলে, তুইও অ্যাসিড ছুঁড়ে প্রতিশোধ নিলি না কেন, আমি বলি তাহলে আমার আর ওই ছেলেগুলোর মধ্যে পার্থক্য কি রইল? আমি ওদের দেখাতে চাই যে অ্যাসিড দিয়ে মুখটা পুড়িয়ে দিয়ে ওরা আমার কোনও ক্ষতিই করতে পারেনি। আমি একই রকম আছি।”
প্রতিদিন লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করার সময় মনীষার প্রতি আশপাশ থেকে ভেসে আসে দয়া আর করুণা মিশ্রিত নানান মন্তব্য। কিন্তু কারোর করুণার পাত্রী হতে রাজি নন তিনি। উল্টে তিনিই তার সহযাত্রীদের বোঝান, প্রত্যেকের লড়াইটা তাঁর নিজের কাছে। কে কিভাবে তাঁর জীবনটাকে দেখছে তার ওপর নির্ভর করে কেমন হবে তার যাত্রাপথ। “যে দোষী সে তো মুখ ঢেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে না। তাহলে বিনা দোষে আমি কেন মুখ ঢাকব,” বোঝানোর চেষ্টা করেন মনীষা।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
নিজের কষ্টের দিনগুলোর কথা শোনাতে গিয়ে মনীষা বললেন, “তিন বছর আগে যখন ঘটনাটা ঘটে, তখন ভেবেছিলাম সিনেমায় যেমন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়া যায়, তেমনই হয়ত শীঘ্রই সেরে উঠব আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন চোখ, নাক, কান নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করল, তখন বুঝলাম যে বাস্তবটা সিনেমার মত নয়। এই চিকিৎসা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। হয়ত আজীবন এই চেহারাটা নিয়েই ঘুরতে হবে আমাকে।”
চিকিৎসা চলছে, তবে রাতারাতি বাইরের ক্ষতটাকে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয় সেটা জানেন মনীষা। তখন ভেতর থেকে নিজেকে শক্ত করেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে ঘুরে দাঁড়ান। হেরে গেলে চলবে না। দেখিয়ে দিতে হবে তিনি ফুরিয়ে যাননি। ওদের ছুঁড়ে দেওয়া অ্যাসিডের ক্ষত ম্লান করে দিতে পারেনি তার অন্তরের সৌন্দর্যকে।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
“সকলেই সুন্দর মুখ, সুন্দর চুল দেখতে ভালোবাসেন। আমি এই ঘটনার পরেও সেজেগুজেই বাইরে বেরোই। আমি সাজতে ভালোবাসি, এতকিছুর পরেও এই মুখ নিয়ে মডেলিংও করি। একটা সময় ছিল যখন মুখে একটা ব্রণ বেরোলেও আমি বাড়ি থেকে বেরোতে চাইতাম না। কিন্তু আজ আর এসবে আমার কিছু আসে যায় না। আমি শুধু নিজেকে দিয়ে সকলকে বোঝাতে চাই, এভাবেও ফিরে আসা যায়। আমি চুপ করে থাকব না। কারণ চুপ করে থাকলে আমিই কোণঠাসা হয়ে যাব। সেই দিনগুলো আমার খুব কষ্টে কেটেছে। কিন্তু আজ আমি ভালো আছি, অনেক মানুষকে পাশে পেয়েছি। তাঁরা আমাকে নানান ভাবে সাহস যোগান। আজ আর আমার পিছনে ফিরে তাকাবার কোনও দরকার নেই,” প্রত্যয় ঝড়ে পরে মনীষার গলায়।