সমুদ্রের হাতছানি আর টানটান রহস্য
ওয়েব সিরিজ়: মার্ডার বাই দ্য সি
পরিচালনা: অঞ্জন দত্ত
অভিনয়ে: অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, অর্জুন চক্রবর্তী, পায়েল সরকার, সুপ্রভাত দাস, সুজন মুখোপাধ্যায়, তৃণা সাহা, রূপঙ্কর বাগচী, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, অলিভিয়া সরকার, সমরেশ রাউত্রে, অঞ্জন দত্ত
দৈর্ঘ্য: ৩ ঘণ্টা ৮ মিনিট (৮ পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
কথায় বলে প্রকৃতির বিশালতার সামনে দাঁড়ালে মনের সংকীর্ণতা দূর হয়। তাই হয়তো মানুষ ছুটি পেলেই পাহাড়, সমুদ্র বা জঙ্গলের কাছে পৌঁছে যায়। প্রকৃতি হয়তো তার অপার সৌন্দর্যের আলোয় সাময়িকভাবে মানুষকে বিহ্বল করে তুলে তাকে আয়নার সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করে। তবু মানুষের মনের গহীনে জন্ম নেওয়া জটিলতাকে সে ধুয়েমুছে ফেলতে পারে কি? হয়তো সবটা পারে না। এক জীবনে মানুষের ভেতরে গড়ে ওঠা হিংসা, ক্ষোভ, পাপ, লালসা, আক্রোশ, ক্লেশ, গ্লানির কাঠিন্যের কাছে প্রকৃতিও যেন কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ে।
নিজের যন্ত্রণাময় অতীতকে ভুলতে পারে না অর্পিতা সেন (অনন্যা)। পেশায় ক্রাইম থ্রিলার লেখিকা হলেও ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনার জেরে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। নিয়মিত মুড স্টেবিলাইজ়ার ট্যাবলেট খেয়ে তাকে সুস্থ থাকতে হয়। শৈশবের পুরীর স্মৃতি তার কাছে অস্বস্তিকর হলেও ডাক্তারের পরামর্শ মতো সেই শহরেই তাকে আসতে হয়। একমাত্র পুরীই নাকি সুস্থ করে তুলতে পারবে অর্পিতাকে। অগত্যা বাংলা সিনেমার সফল পরিচালক রাজা সেন (অঞ্জন) শুধু স্ত্রীর সুস্থতার কথা ভেবেই পুরীতে বাড়ি কিনে ফেলেন।
সমুদ্র সৈকতে একা ঘুরতে-ঘুরতে অর্পিতার আলাপ হয় বাঙালি ফটোগ্রাফার ও শখের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অরুণ রায়ের (রূপঙ্কর) সঙ্গে। অরুণ কিছুটা জোর করেই অর্পিতাকে বিক্রম রায়ের (সুমন্ত) বাড়ির জন্মদিনের পার্টিতে নিয়ে যায়। সেই পার্টিতে গিয়ে আলাপ হয় বিক্রমের ছেলে অর্জুন (অর্জুন), বিক্রমের শয্যাসঙ্গিনী বিমলা মিশ্র (পায়েল), সেক্রেটারি রমেন দাস (সুপ্রভাত), আইনজীবী বরুণ সামন্ত (সুজন) ও অর্জুনের বান্ধবী গায়িকা রিনা দাসের (তৃণা) সঙ্গে। এদিকে বিক্রম নিজে অনুপস্থিত থাকায় পার্টির তাল কেটে যায়। বরুণের কথা থেকে জানা যায় বিক্রম এই বাড়িটি তার ও রমেনের নামে উইল করে দিয়েছেন। বিমলা বা অর্জুন, উইলে এদের কারও নাম নেই। বিমলার বলা কিছু কথায় অপমানিত বোধ করে পার্টি থেকে বেরিয়ে আসে অর্পিতা।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
পরেরদিন হঠাৎই সমুদ্রের ধারে বিক্রমের মৃতদেহ আবিষ্কার করে অর্পিতা। ইন্সপেক্টর রাউত (সমরেশ) খুনের তদন্ত শুরু করেন। এদিকে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই জীবদ্দশায় বিক্রমকে ঘিরে থাকা চরিত্রগুলো নখদাঁত বার করে ফেলে।
এই খুনের ঘটনায় কৌতূহলী হয়ে নিজের মতো করে অনুসন্ধান করতে চায় অর্পিতা। গোয়েন্দা গল্প লিখতে-লিখতে একটা সময় তার নিজেরই গোয়েন্দা হয়ে ওঠার শখ জাগে। রাজার ইচ্ছে না থাকলেও তাকে জোর করে এই ব্যাপারে মাথা ঘামাতে বাধ্য করে অর্পিতা। প্রত্যেক পর্বে খুলে যায় এক একটি চরিত্রের মুখোশ। শুধু মাঝেমধ্যে শর্মিলা দত্ত ও সূর্যসাগর মুখার্জীর ভূত যেন তাড়া করে বেড়ায় অর্পিতাকে। উঠে আসে অনেকের অতীতের কলঙ্কিত ইতিহাস। গল্প আরও জটিল হয়ে ওঠে।
একই ধরণের ভূমিকা দিয়ে শুরু হয়েছিল অঞ্জনের মার্ডার সিরিজ়ের প্রথম কাহিনী। সেখানেও দার্জিলিংয়ে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি তার জন্মদিনের পার্টিতে খুন হয়ে যান। তাই সেদিক দিয়ে শুরুর ধাঁচটা কিছুটা একরকম লাগলেও, এবারের কহিনী অনেক বেশি জটিল ও টানটান। আট পর্বের প্রতিটিতে এতটাই রহস্য ছড়িয়ে থাকে যে শেষ না করে ওঠা যায় না। রেশ থেকে যায় সিরিজ় শেষ হওয়ার পরেও। মানুষের জীবন ও চরিত্র কত রহস্যময় হতে পারে, তা প্রতিটি পর্বের পরতে-পরতে উঠে আসে।
রহস্য এখানে একটি নয়। একাধিক রহস্য এমনভাবে একে অপরকে জড়িয়ে রয়েছে যে একটার থেকে অন্যটাকে আলাদা করতে গেলে আরও বেশি জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে যেভাবে অর্পিতার চরিত্রের ইতিহাস উঠে আসে, সেভাবে যদি আরও কিছু চরিত্র সম্পর্কে জানা যেত, তাহলে হয়তো দর্শকের পক্ষে ধোঁয়াশা কাটিয়ে নিজের মতো করে কিছুটা তদন্ত করা সহজ হতো। যেমন বিমলার চরিত্রটি আগাগোড়া এক অদ্ভুত আলোছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল। স্পষ্ট হয় না, অতীত-ভবিষ্যত দেখার বিশেষ ক্ষমতা থাকা সত্বেও তাকে লোক ঠকাতে হলো কেন? তাছাড়াও যে শিক্ষিতা মহিলা রোজগারের তাগিদে রক্ষিতা হয়ে থাকতে পারে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও যার সততার কোনও চিহ্ন দেখা যায় না, সে হঠাৎ কিছু বিশেষ ছবির জন্য দেওয়া টাকা ফিরিয়ে দেবে কেন? দু’ লাখ টাকা এমন কিছু কম নয় যে সম্পত্তিতে ভাগ না পেলেও বিমলার ওই টাকার প্রতি কোনও আকর্ষণ থাকবে না। তাছাড়া বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকা সত্বেও অর্পিতার মদ্যপান করা বেশ চোখে লাগে, কারণ সেটা রোগীর ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে পারে।
অন্যদিকে অরুণ চরিত্রটি গঠনে আরও একটু মনোযোগী হওয়া যেত। একেবারেই অকারণে এক ছাত্রের প্রতি এরকম অবসেশন কিছুটা আরোপিত মনে হয়। ছবিগুলো পাওয়ার জন্য অরুণের এই মরণপণ জেদও অবাক করে। তার মতো লোকের পক্ষে এরকম একটা কারণে দু’লাখ টাকা খরচ করা খুব যুক্তিযুক্ত লাগে না।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
অর্পিতার সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিকে মনে করিয়ে দেয়। ব্যোমকেশের কায়দায় বোর্ড পিন দিয়ে প্রত্যেকের নাম আলাদাভাবে গেঁথে রাখার দৃশ্যটি বুদ্ধিদীপ্ত। ভালো লাগে অর্পিতা ও রাজার মধ্যে বোঝাপড়া ও দাম্পত্যের টান দেখতেও। প্রায় কুড়ি বছর বড় একজনের সঙ্গে ঘর করেও অর্পিতা রাজার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে, এই ব্যাপারটা কিছু ফিলগুড মুহূর্ত উপহার দেয়। এতগুলো ধোঁয়াটে চরিত্রের মধ্যে রমেনের সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ দর্শককে কিছুটা স্বস্তি দেবে। তবে আগ্নেয়াস্ত্রের বাড়াবাড়ি বেশ চোখে লাগে। প্রায় সকলের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র থাকাটা আর যাই হোক বাস্তবসম্মত নয়। ভালো লাগে সিরিজ়ের প্রতিটি শারীরিক সংঘাতের দৃশ্যের অবতারণা। সব ক্ষেত্রেই সেগুলি বেশ বাস্তবসম্মত হয়ে উঠেছে।
সুযোগ থাকা সত্বেও, চিত্রনাট্যে প্রয়োজন না থাকায় কোনও যৌনদৃশ্যের অবতারণা করেননি পরিচালক। এই সংযম আজকের দিনে অবশ্যই প্রশংসনীয়। অথচ এই পর্বের কাহিনী আগাগোড়াই প্রাপ্তমনস্ক। তরুণ পরিচালকরা এ ব্যাপারে প্রবীণের কাছে শিক্ষা নিতে পারেন বইকি!
অভিনয়ের ক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হয় অনন্যার কথা। অন্যান্য বেশ কিছু চরিত্রে হয়তো অন্য কোনও অভিনেতা মানিয়েও যেতে পারতেন, কিন্তু অর্পিতা চরিত্রটি একেবারেই অনন্যার জন্য তৈরি। পরিচালককে ধন্যবাদ এরকম একটি শক্তিশালী ও আবেগপ্রবণ চরিত্রে অনন্যাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অভিনয়ের গুণে চোখ ফেরাতে দেন না অনন্যা। বাইপোলার চরিত্র হিসেবে স্ববিরোধী নানা অভিব্যক্তিকে দক্ষতার সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরেছেন তিনি। বিভিন্ন সাজেও তাঁকে অনন্যাই লেগেছে। অভিনয়ের জগতে পুরোপুরি ফিরে আসার জন্য এরকম একটি চরিত্রের প্রয়োজন ছিল তাঁর।
সুপ্রভাতকে এর আগেও নানা ধরণের চরিত্রে ব্যবহার করেছেন অঞ্জন। বলা বাহুল্য সুপ্রভাত কখনওই হতাশ করেন না। এখানেও করেননি। অর্জুনের চরিত্রটি কিছুটা একই গতে বাঁধা হওয়ায় তাঁর বিশেষ কিছু করার ছিল না। যতটুকু তাঁর পরিসরে থেকে করা যায়, তিনি করেছেন। রহস্যময়ীর চরিত্রে বেশ মানানসই লেগেছে পায়েলকে। বাকিরা সকলেই চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
আলাদাভাবে বলতেই হয় অঞ্জনের কথা। পরিচালনার বাইরে তাঁর অভিনয় চিরকালই মুগ্ধ করে, এখানেও তার অন্যথা হয়নি। রাজা সেনকে পর্দায় এমনভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি যে কোথাও গিয়ে মনেই হয় না অঞ্জনে নিজে এই সিরিজ়ের পরিচালক। ভবিষ্যতে নিজের পরিচালনায় আরও কঠিন চরিত্রে অঞ্জনকে দেখার আশা রইল। বিক্রমের ভূমিকায় সুমন্তকে আরও কিছু দৃশ্যে ব্যবহার করা যেত।
নীল দত্তের সুরে প্রজ্ঞার গলায় গানটি ভালো লাগলেও বড় অল্প শোনানো হলো। সোমলতা আচার্যের গাওয়া শীর্ষসঙ্গীতে রহস্যের আবহ শুনতে ভালো লাগে। রূপঙ্করের খালি গলায় গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত বরাবরের মতোই শ্রুতিমধুর। প্রভাতেন্দু মণ্ডলের চিত্রগ্রহণ চোখকে আরাম দেয়। অর্ঘ্যকমল মিত্রের সম্পাদনা যথাযোগ্য।
সমুদ্রের হাতছানি আর টানটান রহস্য, এই দুইয়ের মিশ্রণে পুরী ভ্রমণ যে দার্জিলিংয়ের থেকে অনেক বেশি জমজমাট হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরের গন্তব্য হয়তো জঙ্গল।