বাঁধা গতের বাইরে গিয়ে

ছবি: মুখোশ

পরিচালনা: অর্ঘ্যদীপ চট্টোপাধ্যায়

অভিনয়ে: পায়েল সরকার, রজতাভ দত্ত, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, অমৃতা হালদার, প্রান্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১০ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

বাঙালি দর্শক যে বড়পর্দায় রহস্য গল্প দেখতে একটু বেশীই ভালোবাসে এ কথা গত দশটা বছরে প্রমাণিত হয়ে গেছে। একটা গোটা দশক ধরে নানা ধরণের ও গোত্রের থ্রিলার ছবি মাতিয়ে রেখেছিল বাংলা ছবির বাজারকে। সেই ধারা যে নতুন দশকেও একইভাবে প্রবহমান থাকবে এ কথা বলাই যায় কারণ এই দশকের শুরুটাও হলো রহস্য দিয়েই, এবং তা হুডানইট গোত্রের কাহিনীর মাধ্যমে। অর্ঘ্যদীপের থ্রিলার ‘মুখোশ’ সেই ধারাকে সফলভাবেই কিছুটা এগিয়ে দিল বলা চলে। 




গত দশকের সম্ভবত সেরা ভারতীয় হুডানইট ‘কাহানি’ প্রমাণ করে দিয়েছে যে এই ধারায় ছবি করতে হলে শুধুমাত্র ভাল অভিনেতা হলেই চলে না, চাই একটা টানটান চিত্রনাট্য। ‘মুখোশ’ দেখতে বসে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে তা হলো ছবিটি সবদিক থেকেই মেদহীন। ছবির গল্প শুরু হয় অন্তরার (অমৃতা) থানায় যাওয়া দিয়ে। শহরের প্রভাবশালী নেতা ও কন্ট্রাক্টর রণজয় সান্যালের (রজতাভ) বিরুদ্ধে সে ডায়রী করতে চায়, কারণ তার দিদি উত্তরার কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এখানে কোথাও উল্লেখ করা হলো না যে উত্তরা রণজয়ের স্ত্রী। সেটা বুঝে নিতে হয় দর্শককে।

যাই হোক, ইন্সপেক্টর সব্যসাচী ব্যানার্জী (শান্তিলাল) অন্তরাকে জানান যে এত সহজে এমন ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখানো যায় না, তবু তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। অন্তরাকে নিয়ে রণজয়ের বাড়িতে পৌঁছলে তিনি সমস্ত ঘটনা অস্বীকার করেন ও জানান যে উত্তরার কোনও বোন আছে তা তিনি আগে জানতেন না। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার কারণে সম্প্রতি সে কোথাও চলে গেছে এবং হয়তো আবারও কিছুদিনের মধ্যে ফিরেও আসবে, এ কথাও জানা যায় রণজয়ের বয়ানেই। কিন্তু হাল ছাড়েন না সব্যসাচী। চুপচাপ তদন্ত করতে শুরু করে দেন তিনি।

আরও পড়ুন: নির্বাক, ব্যতিক্রমী ভাবনার নাটক ‘কনডেমড সেল’

ওদিকে সাম্য (প্রান্তিক) ও অন্তরা নিজেদের মতো খোঁজ করতে গিয়ে পৌঁছে যায় রণজয়ের অফিসে। ব্যানার্জীর কাছে খবর যায়। তিনি অন্তরাকে নিজের বাড়িতে থাকতে বলেন, যদিও সেটা বেশ অদ্ভুত ঠেকল। অন্তরাও নিজের সুবিধার কথা ভেবেই সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। আবার একজন অন-ডিউটি সিনিয়র অফিসার সারাদিন মদ্যপান করে যাচ্ছেন ও সেইভাবেই সর্বত্র কেসের প্রয়োজনে বিচরণ করছেন, এটাও অস্বাভাবিক লাগল। ব্যানার্জী চরিত্রটিকে সুস্থ, স্বাভাবিক করলেও গল্পের বিশেষ কোনও ক্ষতি হতো না। আর এমন অগোছালো ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত অফিসারের বাড়ি কীভাবে এত সাজানো গোছানো ও পরিপাটি হয় তাও বোধগম্য হলো না।

গল্পে কোথাও একটা টুইস্ট আছে সেটা বিরতির পর থেকেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল। সেদিক থেকে গল্পের মোড় পরিবর্তন বেশ স্বস্তি দেয়, কেন না এত সাদামাঠাভাবে যে উত্তরার অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান হবে না তা ছবির নামেই স্পষ্ট। কিন্তু সেই টুইস্ট থেকেই গল্পের গতি কেমন যেন থিতিয়ে যায়। অথচ এই পর্ব হতে পারত সবচেয়ে চমকপ্রদ। কিন্তু চিত্রনাট্যের দুর্বলতায় ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে গল্পের চমক ব্যানার্জীর প্রতিক্রিয়ার মতোই ঠান্ডা মেরে গেল। পামেলা (পায়েল) চরিত্রটি যে শুধুই রণজয়ের শয্যাসঙ্গিনী নয়, তাও আন্দাজ করা গিয়েছিল।

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

বেশ কিছুটা ধোঁয়াশা থেকে গেল মূল গল্পের সূত্রে। উত্তরা চরিত্রটি যে কি না এত দাপুটে বলে জানা গেল তাকে পর্দায় দেখে কোথাও তেমন মেজাজি মনে হলো না। চরিত্রটিকে আর একটু দেখালে ছবির ক্ষেত্রে বোধহয় সুবিধাই হতো। তেমনই সাম্য চরিত্রটিও আগাগোড়াই ধোঁয়াশা রেখে যায়। সে কী করে, কেন এতখানি সময় উত্তরার অন্তর্ধানের পিছনে ব্যয় করছে তাও স্পষ্ট নয়। অন্তরার প্রতি মানসিক টান থেকে থাকলেও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন বাইক নিয়ে সারা শহর যে দৌড়ে বেড়ালো তার চরিত্রের একটা প্রেক্ষাপট থাকলে ভালো হতো। 

অভিনয়ের দিক থেকে রজতাভ ও শান্তিলাল দুজনেই অনবদ্য। চিত্রনাট্য আরও একটু শক্তিশালী হলে এঁরা অনেকটা বেশী অভিনয়ের পরিসর পেতেন বলে মনে হয়। পায়েল তাঁর চরিত্রের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। অভিনয়ের জগতে প্রথম পা রাখা অমৃতা কিছু জায়গায় বেশ ভালো। তবে এখনও অনেক শিখতে হবে তাঁকে। সাম্যর চরিত্রে প্রান্তিকের বিশেষ কিছু করার ছিল না। খুবই স্বল্প সুযোগে তিনি নিজের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। ভবিষ্যতে বড় চরিত্রে তাঁকে দেখার অপেক্ষা থাকবে। সোমলতার কণ্ঠে গানটি শুনতে ভালো লাগলেও প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে সেটা আর মনে থাকে না। মধুরা পালিতের দৃশ্যগ্রহণ বেশ ভালো। বিশেষ করে ড্রোন শটে নতুন কলকাতার রাস্তাঘাট দেখতে ভালো লাগে।

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

কিছু খামতি থাকলেও বিষয়ের দিক থেকে বেশ অভিনব ‘মুখোশ’। শুরু থেকে গল্পের গতি এগোয় তার নিজস্ব ছন্দে, কোথাও তা দর্শকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় না। কিছু ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য আর একটু জোরদার হলে গল্প আরও টানটান হতে পারত। ক্লাইম্যাক্সে নাটকীয়তার সঙ্গে স্বচ্ছতার সঠিক মিশ্রণ হলে ছবির শেষাংশ মনে রেখে দেওয়ার মতো হতে পারতো। তবু বাঁধা গতের থেকে বেরিয়ে অন্য ধারার থ্রিলার হিসেবে ‘মুখোশ’ দর্শকের ভালো লাগবে। দুই তুখোড় অভিনেতার যুগলবন্দি দেখার জন্য একবার অন্তত হলে গিয়ে এ ছবি দেখা যেতেই পারে।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *