সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার সাহস

ছবি: লক্ষ্মী ছেলে

পরিচালনা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

অভিনয়ে: উজান গঙ্গোপাধ্যায়, ঋতিকা পাল, পূরব শীল আচার্য, ইন্দ্রাশিস রায়, চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, প্রদীপ ভট্টাচার্য

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১০ মিনিট

RBN রেটিং: ৪/৫

‘প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরিয়া ছাত্রদিগকে এই বৈজ্ঞানিক সত্যের ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া আসিলাম। তাহারাও বেশ বুঝিল এবং মানিয়া লইল, কিন্তু গ্রহণের দিন যেই ঘরে ঘরে শঙ্খঘন্টা বাজিয়া উঠে এবং খোল-করতালের সহযোগে দলে দলে কীর্তনীয়রা রাস্তায় মিছিল বাহির করে, অমনি সেই সকল সত্যের পূজারীরাও সকল শিক্ষাদীক্ষায় জলাঞ্জলি দিয়া দলে দলে ভিড়িতে আরম্ভ করে এবং ঘরে ঘরে অশৌচান্তের মতো হাঁড়িকুড়ি ফেলার ধুম লাগিয়া যায়।’



উপরের উক্তিটি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের এবং প্রায় সকলেরই জানা। যে কোনও ঘটনার পিছনে থাকা বৈজ্ঞানিক যুক্তির আদি উৎস জানা থাকলেও বহু মানুষ সারাজীবন কুসংস্কারের কূপমন্ডুক হয়ে কাটিয়ে দেয়। তাই পুত্রসন্তানের আশায় জাঁকজমক করে পালিত হয় জন্মাষ্টমী। এমনকি হাসপাতালে অগ্রিম কেবিনেরও বন্দোবস্ত করে রাখা হয়। কখনও দুধ খেয়ে ওঠে গণেশ, কখনও বা মা মনসার গায়ে সাপ ওঠার ঘটনা ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। কৌশিকের ‘লক্ষ্মী ছেলে’ এরকমই এক মানবলক্ষ্মীর পাঁচালী।

কলকাতার তিন ডাক্তারি পড়ুয়া আমির (উজান), শিবনাথ (পূরব) ও গায়ত্রী (ঋতিকা) হঠাৎ করেই এক অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হয়। পুরুলিয়ার এক গ্রামে তাদের গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় আটকে পড়ে তারা। সেখানেই তাদের সঙ্গে আলাপ হয় সাংবাদিক জয় মিত্রের (অম্বরীশ)। জয়ের কাছ থেকে তারা জানতে পারে, হিজলগঞ্জের ডোংজুড়ি গ্রামে চারহাত সম্পন্ন এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়েছে। নীচু শ্রেণীর এই পাড়ায় যেখানে ছায়া মাড়ানোই পাপ, সেখানে দেবী রূপী এই কন্যার আগমণের কারণে রীতিমতো মেলা বসে গেছে। গ্রামের জমিদারবাড়ির ছোটছেলে রজত নারায়ণের (ইন্দ্রাশিস) তত্ত্বাবধানে হাজার-হাজার মানুষ দূর থেকে মা লক্ষ্মীকে ভেটসহ দর্শন করতে আসে।

আরও পড়ুন: রেগে আগুন কমল মিত্র, সুবিধা হলো সত্যজিতের

কৌতূহলবশত ডোংজুড়ি পৌঁছে যায় আমির, শিবতোষ ও গায়ত্রী। ধর্মের ঘেরাটোপে নিজের গা বাঁচাতে বন্ধুদের দেওয়া অমরনাথ নাম নিয়ে আমির লক্ষ্মীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রণামের অছিলায় পায়ে হাত দিয়ে আমির বুঝতে পারে বাচ্চাটির ধুম জ্বর। সে বুঝতে পারে ধর্ম, কুসংস্কার ও বিজ্ঞানের এই ত্রিভুজের মধ্যবিন্দুতে সে আটকে গেছে। সেই স্থান থেকেই আমির তার শিক্ষিকা ডঃ মিতালি সেনকে (চূর্ণী) ফোন করে। মিতালি সব শুনে আসল ঘটনা অনুধাবন করতে পারে। বাচ্চাটির বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলে তাদের বোঝাতে পরামর্শ দেয় মিতালি। তবু আইন ও ধর্মের বেড়াজালে আটকে গিয়ে আমিরকে বাড়াবাড়ি করতে সে বারণ করে।

লক্ষ্মী আসলে পার্শিয়াল টুইন। অর্থাৎ মাতৃগর্ভে যমজ সন্তানের একজন শারীরিক ভাবে পুষ্ট হলেও অন্য সন্তান অপরিণত থেকে যায়। এক্ষেত্রে পরিণত সন্তানটির দেহে অপরিণত সন্তানের কিছু অঙ্গ যুক্ত হয়ে থাকে। লক্ষ্মীর ক্ষেত্রেও তাই দু’হাতের বদলে চারহাত। শুধুমাত্র বাইরের দিক থেকে নয়, ভূমিষ্ঠ সন্তানটির দেহের ভেতরে তার যমজের ইন্টারনাল অর্গ্যানও রয়ে যায় যুগ্ম অবস্থায়। সেক্ষত্রে অস্ত্রোপচার না করলে বাচ্চাটিকে বাঁচানো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে যায়। ইন্টারনেটে এই বিষয়ে খুঁজলে হাজারো কেস স্টাডি পাওয়া যাবে। এখানে দৈবশক্তির কোনও ভূমিকা থাকে না।

আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন

ছবির বিষয়বস্তু এতটাই জোরালো যে মনেই হয় না কোনও অভিনেতা আসলে অভিনয় করছেন। উজান, পূরব ও ঋতিকাকে ভালো লাগতে বাধ্য। চূর্ণী, বাবুল, ইন্দ্রাশিস, অম্বরীশ, প্রদীপ এঁরা প্রত্যেকেই দক্ষ অভিনেতা। প্রত্যেকে তাঁদের সেরাটা দিলেন। ছবির গান যথোপযুক্ত। সবথেকে ভালো লাগে ছবির আবহসঙ্গীত। গল্প ভালো হলে অর্ধেক যুদ্ধ জিতে নেওয়া যায়। এই ছবির চিত্রনাট্য সেরকমই ঝরঝরে, মেদহীন। কোথাও অতিরিক্ত জ্ঞান প্রদর্শন নেই। অহেতুক রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়াও নেই। যুক্তির মাধ্যমে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার সাহস দেখায় এই ছবি। সেই জন্যই এই ছবি সম্পূর্ণ আলাদা।

‘লক্ষ্মী ছেলে’র মতো ছবি বাংলায় খুব বেশি তৈরি হয়নি। এই ধরণের ছবি তৈরি করতে গেলে স্পর্ধা লাগে। যেমন ছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’। শিক্ষণীয় ছবির জগতে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *