অধিক সন্ন্যাসীতে হারিয়ে গেল অনেক দক্ষ অভিনেতার কাজও
ছবি: মায়া
পরিচালনা: রাজর্ষি দে
অভিনয়ে: গৌরব চক্রবর্তী, তনুশ্রী চক্রবর্তী, রফিয়ত রশিদ মিথিলা, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, কনীনিকা বন্দোপাধ্যায়, রণিতা দাস, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, রোহিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশান মজুমদার, গৌরব চট্টোপাধ্যায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৫২ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆
কথায় বলে লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। তবে মৃত্যু অত সহজে ধরা দেয় না। তাই লোভ এবং পাপের মধ্যেই ঘুরতে থাকে মানুষের জীবনচক্র। কিছু আদিম প্রবৃত্তি যা মানুষের মধ্যে সেই জঙ্গলের জীবনেও ছিল, আজও রয়ে গেছে সমানভাবে। ষড়রিপুর খেলায় এখনও মানুষ চিরকালের মতোই অসহায়, তাই বোধহয় উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা নাটকগুলো আজও সমান প্রাসঙ্গিক। মূলত হিউম্যান নেচার বা মানুষের প্রবৃত্তিকে ঘিরে লেখা তাঁর নাটকগুলো কখনও পুরনো হয় না। রাজনৈতিক পালাবদল, তথা এক রাজার পতন ও অন্য রাজার উত্থান এবং শেষমেশ গোটা সিস্টেমের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, এই নিয়েই শেক্সপিয়রের জনপ্রিয় নাটক ম্যাকবেথ। স্কটল্যান্ডের রাজপ্রাসাদের প্রেক্ষাপটে লেখা সেই গল্পকে রাজর্ষি তুলে এনেছেন বর্তমান কলকাতার প্রেক্ষাপটে, ব্যাকড্রপে রয়েছে ১৯৮৯ সালের ইতিহাস। কেমন হলো ম্যাকবেথ অবলম্বনে ‘মায়া’?
দরবার শর্মার (কমলেশ্বর) বিরাট ব্যবসা। লোকে তাকে শহরের রাজা বলে। নানা ইন্ডাস্ট্রিতে টাকা ঢালার পাশাপাশি সোজা এবং বাঁকা পথে সিনেমাতেও তিনি বিনিয়োগ করে থাকেন। সে ছবি রঙিন হোক কিংবা নীল। বিগত সময়ের নামকরা নায়িকা পারমিতা (কনীনিকা) থেকে বর্তমান সময়ের মৃণালিনী (তনুশ্রী) এরা সকলেই তার কেনা। দরবারের রাজপ্রাসাদে থেকে তারই ঠিক করে দেওয়া ছবিতে এরা কাজ করে। প্রযোজনায় থাকেন শর্মাজি। তার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকে তার ছেলে মায়াঙ্ক (রাহুল) ও পুত্রবধূ রেশমি (সুদীপ্তা)। ব্যবসা সংক্রান্ত সমস্তরকম কুকর্মে দরবারের ডানহাত মাইকেল (গৌরব)। প্রভুকে খুশি রাখতে সে যে কোনও অপরাধ করতে প্রস্তুত। কিন্তু মায়া নামের এক রহস্যময়ী নারী তার মধ্যে সিংহাসনের খিদে জাগিয়ে তোলে। আগাগোড়া প্রভুভক্ত মাইকেল জড়িয়ে যায় রাজনীতির খেলায়। মূল গল্প এই হলেও এর আশেপাশে রয়েছে প্রচুর সাবপ্লট এবং অজস্র চরিত্রের ভিড়।
আরও পড়ুন: “আর ভালো লাগছে না”
ম্যাকবেথের কাহিনির মূল ছক থেকে অনেকটাই সরে এসেছে এই ছবির গল্প। ২০২৩-এ এসে ডাইনি আর রাজার গল্প চলে না। তাই দরবারের অতীতই তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের প্রতিটি সদস্য দরবারের শত্রু এবং প্রত্যেকেই তার মৃত্যু কামনা করে। দরবারের অত্যাচারে একটা সময় তার শত্রু হয়ে দাঁড়ায় তার প্রেয়সীরাই। যদিও মূল গল্পে ক্ষমতার লোভ তছনছ করে দিয়েছিল রাজার সিংহাসন, তবে এখানে তার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত আক্রোশ।
গল্পের একাধিক সাবপ্লটের প্রয়োজনে এসেছে রেশমীর মেয়ে অয়ন্তিকা, ফিল্মমেকার আকৃতি ও তার বান্ধবী, ডান্স বারের মেয়ে মাহি, পরিচারিকা চুমকি, আর্টিস্ট ফলক, এমন অনেক চরিত্র। এতরকম গল্পের গলিঘুঁজিতে ছুটতে গিয়ে প্রত্যাশিতভাবেই পথ হারিয়েছে ছবির মূল প্লট। ধর্ষণ এবং তার থেকে তৈরি একটা প্রতিহিংসার গল্প বলতে গিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে এত রাস্তা ঘুরে আসার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। চিত্রনাট্য এবং সম্পাদনা দুই বিভাগেই আরও যত্নের প্রয়োজন ছিল। অনেকগুলো চরিত্র যেমন না থাকলেও চলত, তেমন অধিক সন্ন্যাসীতে হারিয়ে গেল অনেক দক্ষ অভিনেতার কাজও।
ছবির প্রেক্ষাপটে আছে উত্তরপ্রদেশের কয়েকজন মানুষ। ফলে সংলাপ এসেছে দুই ভাষাতেই। চিত্রনাট্যের চল্লিশ শতাংশই যেখানে হিন্দিতে কিংবা হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় মিশিয়ে সেখানে হিন্দি উচ্চারণের ওপর অনেক বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল। সংলাপ যেখানে এত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে ছবির অধিকাংশ অভিনেতার ভুল উচ্চারণে হিন্দি বলা বিরক্তির উদ্রেক করে। মায়ার চরিত্রটি শুরু থেকেই কেন বাংলাদেশের বাংলা উচ্চারণ ও হিন্দি মিশিয়ে কথা বলে বোঝা গেল না। যদি সে বাংলাদেশি হয় তবে তার হিন্দি বলার যৌক্তিকতা থাকে না। পরবর্তীতে মায়া সারাক্ষণই হিন্দিতে কথা বলে গেল। কেন, তার কারণ বলা হয়নি। এই চরিত্রটা গড়ে ওঠারও কোনও ইতিহাস নেই। তিরিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ধর্ষণ তাকে কীভাবে এমন রহস্যময়ী করে তোলে, কার প্রভাবে সে মায়া হয়ে ওঠে তার কোনও ব্যখ্যা নেই, ফলে চরিত্রের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে ওঠে না। এই চরিত্রের মেকআপ নিয়েও আরও ভাবনাচিন্তা করা যেত। যেখানে তার সমসাময়িক অন্য চরিত্রদের বয়স বেড়েছে, ব্যক্তিত্ব বদলেছে সেখানে মায়া কী করে একইরকম থেকে যায় তার কোনও উত্তর ছবিতে দেওয়া হয়নি। শুধু মাথার জটা দিয়ে বয়স প্রমাণ করা যায় না, মুখের পেশিরও বয়স বাড়ে, এটা পরিচালকের বোঝা উচিত ছিল।
আরও পড়ুন: নেতাজির পর আরও এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর চরিত্রে রাজুকমার
ছবির শেষ দৃশ্যে একাধিক মোচড় গল্পকে হাস্যকর পরিণতি দেয়। প্রথমত আশির দশকের হিন্দি ফিল্মের ধাঁচে ক্লাইম্যাক্স এবং একে-একে মুখোশ খুলে সকলেই প্রশাসনিক প্রধান হয়ে যাওয়া সেই একই প্লট বিরক্তি ছাড়া আর কিছু জাগায় না। পুলিশ কমিশনার আর আন্ডারকাভার এজেন্টের মধ্যে তফাৎ দর্শক বুঝবে না এমনটা ভাবা বোকামি।
চিত্রনাট্য দুর্বল হলেও আবহ সঙ্গীত শুনতে মন্দ লাগে না। রণজয় ভট্টাচার্যের সুরে ও রাজর্ষির কথায় রূপঙ্কর বাগচীর কণ্ঠে শীর্ষ সঙ্গীত এবং সোমলতা আচার্যের কণ্ঠে ‘জোনাকি জ্বলে উঠুক’ দুটি গানই অন্যরকম এবং শ্রুতিমধুর। ডাবিংয়ের সমস্যায় কিছু জায়গায় সংলাপ শুনতে পাওয়া যায় না। কনীনিকা এবং সুদীপ্তার একটি দৃশ্যে যেখানে সংলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেখানে বেশিরভাগ কথাই ঢাকা পড়ে যায় গাড়ির আওয়াজে। সম্পাদনার দিকে একটু নজর দিলে অনেক অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য বাদ দিয়ে ছবির দৈর্ঘ্য কমানো যেতে পারত। ছবির চিত্রগ্রহণ দেখতে ভালো লাগে।
অভিনয়ে সকলেই কমবেশি ভালো। নেগেটিভ চরিত্রে নিজেকে অনেক বেশি মানানসই হিসেবে আবারও প্রমাণ করলেন গৌরব (চক্রবর্তী)। দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। চমকে দেওয়ার মতো অভিনয় করেছেন সুদীপ্তা। উত্তরপ্রদেশের এক পুরোহিতের মেয়ের চরিত্রে অসম্ভব সুন্দর অভিনয় করলেন তিনি। প্রতিটি দৃশ্যে তাঁর অভিনয় অসাধারণ। এছাড়াও ভালো লেগেছে কনীনিকা, কমলেশ্বর, রাহুল এবং রণিতার অভিনয়। মূল নাটকে ব্যাঙ্কোর ভূমিকা অনেক বেশি থাকলেও এখানে বাসুদেবের চরিত্রটি প্রায় গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে। তবু সেই কয়েক মিনিটের পরিসরে ভালো লেগেছে ঈশানের অভিনয়। নতুন মুখ হিসেবে রোহিত যথেষ্ট ভালো। তাঁর মুখোশের আড়ালের চরিত্রে সুন্দর মানিয়ে গিয়েছেন তিনি। তনুশ্রী কিছুটা চড়া অভিনয় করলেন, সম্ভবত দুর্বল চিত্রনাট্যের কারণেই। তাঁকে দেখতে আগাগোড়াই খুব সুন্দর লেগেছে। মিথিলা তাঁর প্রথম ছবি হিসেবে ভালোই, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নিজেকে আরও প্রস্তুত করবেন তিনি। অনিন্দ্য এবং গৌরব (চট্টোপাধ্যায়) দুজনেই ছোট পরিসরে যথাযথ।
শেক্সপিয়রের ক্লাসিক অবলম্বনে বাংলা ছবি নিয়ে প্রত্যাশা ছিলই। উপরন্তু একাধিক দক্ষ অভিনেতার সমাহার আশা জাগিয়েছিল। স্কটল্যান্ডের রাজপ্রাসাদের গল্পকে বাংলার প্রেক্ষাপটে নামানোর প্রাথমিক ভাবনা সত্যিই আশাপ্রদ ছিল। তবে চিত্রনাট্য ও নির্মাণের ক্ষেত্রে আর একটু যত্ন নিলে আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারত ‘মায়া’।
