সেলুলয়েডের পথিকৃৎকে সার্থকভাবে চেনায় ‘হীরালাল’
ছবি: হীরালাল
পরিচালনা: অরুণ রায়
অভিনয়ে: কিঞ্জল নন্দ, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর চক্রবর্তী, অনুষ্কা চক্রবর্তী, তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৯ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
হীরালাল সেন বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে এক বিস্মৃত নাম। শুধু স্থিরচিত্রই নয়, ক্যামেরার লেন্স দিয়ে চলমান ছবিও যে তোলা যায়, সেটা ইনিই প্রথম ভেবেছিলেন। শুধু ভাবেনইনি, তৈরি করেছিলেন প্রথম সিনে-বিজ্ঞাপন, তথ্যচিত্র, মায় একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও। তবু অদৃষ্টের পরিহাসে তাঁর যতটা পরিচিতি পাওয়ার কথা ছিল, তার কণামাত্রও না পেয়ে, সর্বস্বান্ত হীরালাল কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। সেই হীরালালের জীবনকে বড় পর্দায় তুলে এনেছেন অরুণ।
হীরালালের (কিঞ্জল) বাল্যকাল থেকে এ ছবির শুরু। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছিল ছবি তোলার শখ। শুরুতে বাল্যকালের বিভিন্ন ঘটনা দেখানোর পরেই ছবি জাম্পকাটে চলে যায় মূল পর্বে, অর্থাৎ হীরালালের যৌবনকালে। ক্রমে স্থিরচিত্র থেকে চলমান ছায়াছবি তোলার শখ, সেখান থেকে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের (অর্ণ) সঙ্গে সখ্যতা, নানা তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতার শেষে হীরালালের মৃত্যুতে এ ছবির সমাপ্তি।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শককে পর্দায় আকৃষ্ট করে রাখে ‘হীরালাল’। প্রত্যেক অভিনেতাই তাঁদের নিজ-নিজ ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয় করেছেন। হীরালালের স্ত্রী হেমাঙ্গিনীর ভূমিকায় অনুষ্কা থেকে মাত্র কয়েকটি দৃশ্যের জন্য উপস্থিত হওয়া নাট্যজগতের কিংবদন্তী গিরিশচন্দ্র ঘোষের চরিত্রে খরাজ, প্রতিটি শিল্পীই দর্শককে মাতিয়ে রাখলেন। অর্ণর অভিনয়ে থিয়েটারি ছাপ থাকলেও চরিত্র অনুযায়ী তা একেবারে যথাযথ। ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজক জামশেদজি ম্যাডানের ভূমিকায় নজর কাড়লেন শাশ্বত। তবে তাঁর অভিনয়ে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর উৎপল দত্তের প্রভাব স্পষ্ট। এতে চরিত্রটি কিছুটা হলেও নিজস্বতা হারিয়েছে বলে মনে হয়। কুসুমকুমারী দেবীর চরিত্রে তন্নিষ্ঠার কাজ দর্শকের চোখ ভিজিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন তারিণী উকিলের ভূমিকায় অধিকারী কৌশিক ও মতিলালের ভূমিকায় পার্থ সিনহা। তবে কৌশিকের অভিনয়েও উৎপলবাবুর ছাপ রয়েছে। একটি আদ্যোপান্ত সিরিয়াস ছবিতে কমিক রিলিফের জন্য আনা চরিত্র জবাকুসুম কোম্পানির মালিক সিকে সেনের ভূমিকায় শঙ্করও যথাযথ।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
অরুণ এর আগে ‘এগারো’-র মতো চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাঁর কাজের মান সম্পর্কে দর্শককে একটা ধারণা দিয়েছিলেন। পিরিয়ড ছবি নির্মাণে তাঁর দক্ষতা ঠিক কতটা, তা তিনি ‘হীরালাল’-এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন।
এই ছবির কোনও অংশই অতিরঞ্জিত নয়। যে ইতিহাস মানুষ ভুলতে বসেছে, তাকেই পর্দায় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। এই ছবির সকল চরিত্রই বাস্তব। বিংশ শতকের প্রথমাংশকে তুলে ধরার জন্য সংলাপে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সৌমাভ বসু। পাশাপাশি এ ছবির আরও এক পাওনা হলো চিত্রগ্রহণ। শুরু থেকে শেষ অবধি নানা নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্য ক্যামেরায় গোপী ভগৎ বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখতেই পারেন।
আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
ছবির সময়কাল ও গুরুত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ময়ূখ-মৈনাক জুটি তৈরি করেছেন এই ছবির আবহসঙ্গীত। কখনওই তা অতিগম্ভীর বা বেশি লঘু মনে হয়নি। প্রতিটি দৃশ্যে প্রয়োজনমতো আবহের খেলা চলেছে।
বিংশ শতকের প্রথমদিকের ছবিকে বর্তমান যুগে তুলে আনার আরও একটি বড় অসুবিধা হতে পারত চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট। ছবি চলাকালীন যাতে দর্শক সেই সময়ে চলে যেতে পারেন, তার জন্য বহুল পরিমাণে ভিএফএক্স ব্যবহৃত হয়েছে। দু’-একটি দৃশ্য বাদ দিলে ‘হীরালাল’ দর্শককে কখনওই বুঝতে দেয় না যে এই আবহের প্রায় সবটাই কৃত্রিম।
‘হীরালাল’ যতটা দেশের প্রথম সিনেমা নির্মাতার, ততটাই এক নাট্যকারের নাট্যদলেরও বটে। সে জন্য ছবিতে নাটকীয় উপাদানের ব্যবহার বহুলভাবে পরিলক্ষিত হয়। তবে সেই নাট্য উপাদান যেভাবে ছবির সঙ্গে মিশে গিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। এক ঘন্টার মাথায় ছবির গতি কিছুটা মন্থর হয়ে গেলেও সে মন্থরতা কাটতে বেশি সময় লাগে না। তবে সম্পাদনা আরও নিখুঁত হলে ভালো হতো। হীরালাল ও অমরেন্দ্রনাথের প্রথম আলাপে ‘আপনি’ সম্বোধন থাকলেও পরের দৃশ্যগুলিতে তাঁরা একে অপরকে ‘তুমি’ বলতে থাকেন। আপনি থেকে তুমিতে যাওয়ার এই বন্ধুত্বের উত্তরণটি ছবিতে না দেখানোয় তা একটু চোখে লাগে।
সব মিলিয়ে ‘হীরালাল’ দু’ঘন্টারও বেশি সময় দর্শককে বিংশ শতকে রাখতে সক্ষম। ছবি শেষ হওয়ার পর মন বেশ কিছুক্ষণ ভারাক্রান্ত হয়ে থেকে। এমন একজন কৃতী মানুষকে মনে না রাখার জন্য অপরাধী বলেও মনে হয় নিজেকে। আশা করা যায় এ ছবি আগামী কয়েক দশকেও দর্শকের কাছে ব্রাত্য হবে না। এ ছবির মাধ্যমে ভারতে সেলুলয়েডের পথিকৃৎকে মানুষ নতুন করে চিনবেন।