গল্প বলার নিজস্ব ভাষার পাশাপাশি সাহসের পক্ষে মত প্রসূন, অনির্বাণদের

RBN Web Desk: গতে বাঁধা একই ধরনের ছবির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে ইদানিং ‘সহজ পাঠের গপ্পো’, ‘দোস্তোজি’ বা ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র মতো ছবি প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে সক্ষম হচ্ছে। পাল্টাচ্ছে বাংলা ছবির ভাষা, পাল্টে যাচ্ছে আঙ্গিক। বাংলায় নতুন যুগের ছবি বা নিউ এজ সিনেমা নিয়ে এক মনোজ্ঞ আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। বাংলা অ্যাকাডেমির সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অরিন্দম শীল, মানস মুকুল পাল, প্রসূন চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও রাজ চক্রবর্তী। সঞ্চালনায় ছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।

প্রসূন তাঁর ‘দোস্তোজি’ ছবিতে প্রমাণ করেছেন চেনা ধাঁচের ছবির বাইরে গিয়েও দর্শক আনুকূল্য পাওয়া সম্ভব। তিনি জানালেন, “নিউ এজ সিনেমা মানে রকেট সায়েন্সের মতো নতুন কিছু নয়। আমি মনে করি, এটা একটা ধারাবাহিক পদ্ধতি। আমি দেখব আমার গল্প ও চিত্রনাট্য কী, গল্পের চাহিদা অনুযায়ী ছবির ভাষা, যার মধ্যে সাউন্ড ডিজ়াইন, শট টেকিং পেস, সম্পাদনার গতি, কালার স্কিম সবকিছুই থাকবে। এছাড়াও পরিচালক কীভাবে ছবিটা দেখাতে চাইছেন এই সবকিছু নিয়েই আমার কাছে সিনেমা। সেটা নিউ এজ কিনা আমি জানি না।”

আরও পড়ুন: রেগে আগুন কমল মিত্র, সুবিধা হলো সত্যজিতের

প্রসূনের মতে যে কোনও ছবির ক্ষেত্রে পাটিগণিত থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। “শুরু থেকেই সিনেমা জিনিসটা বাণিজ্যিক কারণেই তৈরি হয়ে এসেছে, কারণ সেটা না করলে তার উদ্দেশ্য সফল হয় না। তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সব ছবিই একটা প্রোডাক্ট। এই প্রোডাক্টটি এতটাই ব্যয়বহুল, যেটায় এতজন মানুষ টাকা লগ্নি করছেন সেই টাকাটা ফেরত না এলে আর একটা এরকম ছবি হবে কী করে? তাই নন্দনের পাশাপাশি মাল্টিপ্লেক্সেও ছবি হাউজ়ফুল হওয়া দরকার,” মনে করেন প্রসূন।

অরিন্দম এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের ‘জয়ল্যান্ড’ ছবির কথা তোলেন। “যে লোকটাকে পাকিস্তানে থাকতে হবে সে এরকম একটা বিষয় নিয়ে ছবি করার সাহস দেখাচ্ছে এইটাই সবচেয়ে বড় কথা, এই সাহসের পরে আসে টেকনিকাল ব্যাপারগুলো,” বললেন তিনি।

আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ

এখানে শুধুমাত্র ছবি তৈরি নয়, সেটা হলে দেখাবার ক্ষেত্রেও আপোষ করতে হয় বলে জানালেন অরিন্দম। সাউন্ড ও ভিডিও প্রজেকশনের ক্ষেত্রে লেভেল কমিয়ে রাখা হয় বলে জানালেন তিনি। ফলে ছবি দেখাবার ক্ষেত্রে সেরা জিনিসটা দেওয়া যায় না। এদিকে দর্শক ভাবছে ছবিটা অন্ধকার। কিন্তু এখানে কোনও প্রেক্ষাগৃহে সেই মাপের প্রজেকশন দেওয়া সম্ভবই নয়।

“এই যত্নটা সকলকে নিতে হবে। একা পরিচালক বা প্রযোজক কী করবেন?” প্রশ্ন অরিন্দমের।



উৎসবের আগেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশের ‘হাওয়া’। মাঝসমুদ্রে ৪৫ দিন ধরে ছবিটি শ্যুট করা হয়েছে। সৃজিত মনে করেন, “এখানে সেটা করা সম্ভবই নয়। সেই বাজেট পাওয়া যায় না। হয়তো এখানে কোথাও পরিচালকদেরও বলা উচিত যে এই ছবির জন্য আমার এতদিনের শিডিউলটাই চাই। এর কমে সম্ভব নয়।”

মানস মুকুলের পরবর্তী ছবি বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের বায়োপিক। তিনি জানালেন “₹৮ কোটি বাজেট মঞ্জুর হয়েও প্রযোজক রাজি ছিলেন না ব্রেক শিডিউলে শুট করতে। এদিকে দীনেশের ফাঁসি হয়েছিল ভরা বর্ষায়। ৭০ দিনের শিডিউল ছিল। তবে সেটা টানা করা সম্ভব ছিল না। কারণ রাইটার্স বিল্ডিংস আক্রমণ হয়েছিল শীতকালে। প্রযোজক বোঝেননি কেন বৃষ্টির সময়েই ফাঁসির দৃশ্যটা করতে হবে? অথচ ফাঁসির সময় দীনেশ দেখছে চারদিক সবুজ ভরে গিয়েছে। সেটা আমি অন্য সময়ে কী করে করব? ভিএফএক্সে সবটা করা যায় না। আমি আপোষ করিনি। অপেক্ষা করেছি। লকডাউনে শ্যুট আটকে গিয়েছিল, আমি হাল ছাড়িনি।”

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

এই প্রসঙ্গে সৃজিতের ‘অটোগ্রাফ’ ছবিটির কথা উঠে আসে। সেখানে ছবিতে একটা আইটেম গান ঢোকাবার প্রস্তাবে প্রযোজককে দেওয়া পরিচালকের উত্তর ছিল ‘সম্ভব হবে না স্যার।’ সৃজিত মনে করেন এই ‘সম্ভব হবে না’ কথাটা জোর দিয়ে বলা জরুরী। 

তবে অনির্বাণ মনে করেন প্রযোজক ও পরিচালককে দুটো পক্ষ বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। “আমরা ছোট থেকে কিছু জিনিস মেনে নিয়ে বড় হই। কারণ আমাকেও বুঝতে হবে অমুক দৃশ্যটা আদৌ বাজেটের দিক থেকে করা সম্ভব কিনা। তাই আমি ‘এটা হতেই হবে, তবে ওটা না হলেও চলবে’ এই মন্ত্রে বিশ্বাসী।”

মঞ্চশিল্পীদের নিয়ে তাঁর প্রথম ছবি করার প্রসঙ্গে অনির্বাণকেও কিছু জায়গায় প্রযোজককে বোঝাতে হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে মধ্য পন্থা অবলম্বন করে কিছুটা মানিয়ে নেওয়ায় বিশ্বাসী তিনি। 

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

অন্য ধরনের ছবি করার প্রসঙ্গে রাজ জানালেন, “আমি প্রথমেই মনে করি হলে কতজন দর্শককে আনতে পারব। আমার কাছে এই অঙ্কটা সবচেয়ে জরুরি। আমি সকলের ছবি দেখি। চেষ্টা করি ভালো ছবি দেখার আর নিজে সেইরকম ছবি তৈরি করার। ২০১৮ সালে আমি আমার ছবির ফরম্যাট বদল করলাম। যেখানে আমি বরাবর প্রযোজকের সামনে গল্প রাখলেই বাজেট পেয়েছি এবার সেই প্রযোজক আমাকে রিজেক্ট করলেন। বললেন এই গল্প চলবে না। তাই আমিও প্রযোজককে রিজেক্ট করে নিজেই প্রযোজনার দায়িত্ব নিলাম। তাই আজ ‘ধর্মযুদ্ধ’ বা ‘হাবজি গাবজি’র মতো ছবি নিয়ে ভাবতে পারছি।” 

সেদিনের সভাকক্ষ উপচে পড়েছিল ফিল্ম স্টাডিজ়ের উৎসাহী ছাত্রছাত্রী ও নতুন ধারার বাংলা ছবির দর্শকদের ভিড়ে।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *