বাঙালি নস্টালজিয়ার সফল উদযাপন
ছবি: মহালয়া
পরিচালনা: সৌমিক সেন
অভিনয়ে: শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্ত, শুভময় চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৪৮ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগদ্মাতার আগমনবার্তা…” কথাগুলো মধ্যে কোনও ম্যাজিক নেই। কিন্তু বছরের একটি বিশেষ দিনে, একজন বিশেষ ব্যক্তির গলায় কথাগুলো উচ্চারিত হলে আজও কেন গায়ে কাঁটা দেয় তার রহস্য অজানা। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নামের এই ম্যাজিকটাই সৌমিক সেনের মহালয়া ছবির প্রধান বিষয়বস্তু বা ছবির নায়ক। আর তাকে সফলভাবে পর্দায় তুলে ধরতে পেরেছেন পরিচালক, কেননা ছবি চলার সময় মনেও থাকে না আমরা এই ২০১৯-এ বসে রয়েছি। পুরো গল্পটাই টাইম মেশিনে করে উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই ১৯৭৫-৭৬ এর দিনগুলোয়, এতটাই নিখুঁত এই ছবির প্রোডাকশন ডিজ়াইন।
১৯৭৫ সালে এমার্জেন্সীর সময় ছবির শুরু। প্রথম দৃশ্যে চমক কিংবা বেশ বড়সড় ধাক্কা লাগায় প্রসেনজিতের লুক। গোটা নব্বই-এর দশক জুড়ে যে নায়কের এন্ট্রি হত সানগ্লাস চোখে, সাদা মাফলার গলায়, কিংবা প্রতিপক্ষের কাউকে এক ঘুষিতে ধরাশায়ী করে, তাকে এমন বাহুল্যবর্জিত চেহারায়, আবেগশূন্য দৃষ্টি, আর কঠিন ও কেজো এক অবাঙালি রেডিও কর্তা হিসেবে দেখতে পাওয়া বেশ নাড়িয়ে দিয়ে যায়। প্রশংসনীয় তার নির্মম চাহনি ও ঠেস দেওয়া সংলাপ। সমগ্র ছবিতে এই শশী সিনহা নামক রেডিওকর্তার খামখেয়ালীপনা গল্পে টান টান ভাব ধরে রাখে। কিশোর কুমারের গান রেডিয়োতে বাজতে দেবেন না বলে যিনি অবহেলায় বলেন, ‘গাঙ্গুলীকে ২০-২৫ বছর পরে কেউ মনে রাখবে না।’ ফলাফলটা কি সেটা ২০১৯-এ বসে আমরাই জানি।
যে জন থাকে মাঝখানে
১৯৫৮ সালে পঙ্কজ মল্লিকের সুরে ও বাণীকুমারের গ্রন্থনায় রেকর্ড করা হয় মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠ ছিল সেই গীতি আলেখ্যর মূল আকর্ষণ। সেই অনুষ্ঠান জনমানসে সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে আজ কিংবদন্তীতে পরিণত। মহালয়ার অনুষ্ঠানের আসল মাহাত্ম্য ছবিতে সঠিকভাবে বলানো হয়েছে মিস্টার ব্যানার্জীরূপী কাঞ্চন মল্লিকের মুখ দিয়ে, ‘রবীন্দ্রনাথের পরে বাঙালির নিজের ঐতিহ্য বলতে যদি কিছু থাকে তা হল এই মহালয়া।’ খুব সামান্য এক ভূমিকায় দক্ষতার ছাপ রেখে গেলেন কাঞ্চন। আজও বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ তাঁর মত অভিনেতাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারল না। পঙ্কজ মল্লিকের ভূমিকায় শুভময় চট্টোপাধ্যায় ছবিতে অন্য মাত্রা যোগ করেছেন। বাঙালি যে নস্টালজিয়া ভালোবাসে তা বোধহয় মহালয়ার এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই আর একবার প্রমাণিত। শশী সিনহারূপী প্রসেনজিৎ সে কথাই বলেছেন বেশ কয়েকবার। যেখানে ‘ওল্ড’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যানার্জী বলে ওঠেন, ‘ইটস গোল্ড স্যার’, এখানেই বাঙালির আবেগ দর্শককে ছুঁয়ে দিয়ে যায়।
শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এ ছবির সম্পদ। কেন যে এরকম শক্তিশালী একজন অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে স্বল্প কিছু মনে রাখার মত চরিত্র পেলেন তা আজও অজানা। সংযমী অভিনয়, গলার স্বরের অদ্ভুত মার্জিত ওঠানামায় বাহ্যিক সমস্ত বিষয়ে নির্লিপ্ত এক সাধক মানুষকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
অন্যদিকে ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ গানের ইন্টারলিউডের মাঝে পর্দায় আসেন উত্তমকুমাররূপী যীশু সেনগুপ্ত। নিজের চলনে বলনে উত্তমের শরীরী ভাষা সুন্দরভাবে রপ্ত করেছেন তিনি। কোথাও মনে হয়নি এতটুকু বাড়াবাড়ি করছেন। তবে কাহিনী ১৯৭৫-৭৬ সালের। সন্ন্যাসী রাজা মুক্তি পেয়ে বক্স অফিসে সাফল্য লাভ করেছে এমনও বলা হচ্ছে ছবিতে, সেখানে উত্তমকুমারের চেহারায় বয়সের ছাপ থাকা উচিত ছিল। যিশুকে দেয়া নেয়া বা এন্টনি ফিরিঙ্গির ছবির সময়ের উত্তম বলে মনে হয়েছে। উত্তমের চরিত্রের বিনয়ের দিক বা বম্বেতে সাফল্য না পাওয়ার যে হতাশা তা যীশুর অভিনয়ে বার বার ধরা পড়েছে। জনতার দাবীতে সন্ন্যাসী রাজার সংলাপ বলা বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মুখে মহালয়ার প্রস্তাব শুনে হেসে উড়িয়ে দেওয়া, সব জায়গাতেই মসৃণভাবে উতরে গেছেন তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে সপ্তর্ষি রায় বেশ মানানসই, চেহারা ও অভিনয় দু দিক দিয়েই।
ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। তাঁর অভিনীত অন্য সমস্ত চরিত্রের মতই এখানেও তিনি একইরকম। কাহিনিতে আলাদা মাত্রা আনে অঘোর সামন্তর চরিত্রটি। সে যুগেও যে ধর্মের দোহাই দিয়ে অব্রাহ্মণকে স্তোত্রপাঠ করতে দেয়ার বিরোধিতা করা হত তা বেশ অবাক করল। একই সঙ্গে তৃপ্তি দেয় নজরুল ইসলামের লেখা ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ গানটির প্রসঙ্গ টেনে আনা। একটি বিশেষ চরিত্রে মুগ্ধ করলেন জয়ন্ত কৃপালনি। অনায়াস দক্ষতায় দর্শকের মন জয় করে নেন অভিজ্ঞ অভিনেতা।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
আলাদাভাবে উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দৃশ্যটি, যেখানে কাহিনী পিছিয়ে যাচ্ছে ১৯৪১-এ। ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটির সঙ্গে মন খারাপ করে দেয় জনতার ঢল ও শোকপ্রকাশের দৃশ্য। ছবির বেশ কিছু সংলাপ মনে রাখার মত। উত্তমের মুখ দিয়ে বলানো ঠাকুর ঘরে সিংহাসন ও সোফাসেটের তুলনামুলক মন্তব্য হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ওই উচ্চতায় পৌঁছেও মানুষ উত্তমকুমার কতটা বিনয়ী আর বড় মনের অধিকারী ছিলেন তা বোঝাতে ওই একটি দৃশ্যই যথেষ্ট।
তবে খটকা থেকে গেল একটি জায়গায়। সকলেই জানে একটা সময়ে উত্তমের সঙ্গে হেমন্তর সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব এসেছিল। যে কারণে জীবনের শেষের দিকের বহু ছবিতে হেমন্তর বদলে মান্না দে বা কিশোর কুমার উত্তমকুমারের লিপে প্লেব্যাক করেন। কিন্তু ছবিতে দুজনের সম্পর্ক এতটাই ভালো দেখানো হল যে কোথাও মনেই হয় না দুজনের মধ্যে কোনও দূরত্ব আছে বা ছিল। যদিও এই ঘটনার আগে মুক্তি পাওয়া ছবি সন্ন্যাসী রাজায় হেমন্ত একটি স্তোত্রপাঠ করেছিলেন, তবু এতটা সহজ সম্পর্ক একটু হলেও সন্দেহ রেখে গেল।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
ছবির দৃশ্যগ্রহণ সেই সময়ের নিরিখে বেশ মানানসই। পৌনে দু ঘণ্টার ছবিতে দর্শকাসনে বসে মনেই হয়নি এটা সত্তরের দশক নয়। তবে একটা বড়সড় খামতি থেকে গেল ছবিতে সঙ্গীতের অভাবে। যে ছবির মূল বিষয়ই মহালয়ার ভোরের সঙ্গীতানুষ্ঠান, সেখানে কিছুটা সময় কি পুরনো নস্টালজিক সুরের মাধুর্যে দর্শককে ভাসিয়ে দেয়া যেত না? গোটা ছবিটাই আকাশবাণীর হঠকারিতার দলিল হয়ে রয়ে গেল, মহালয়ার মুগ্ধতাকে ধরার চেষ্টা করল না।
বহু বছর ধরে সযত্নে লালন করা বাঙালির এক অতিপ্রিয় আবেগ প্রতিবছর মহালয়ার ভোরে মুগ্ধতা দিয়ে যায়। তবে এ ছবি এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কতটা প্রভাবিত করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এই প্রজন্মের অনেকেই মহালয়ার ভোরের ওই ম্যাজিক মুহূর্তকে অনুভব করেনি। তাই হয়ত একটা বিশেষ বয়সের পর এই ছবির আবেদন তেমনভাবে কাজ করবে না।
খুব সুন্দর লেখা