আজও তিনিই সেরা ক্রাউডপুলার
ছবি: অতি উত্তম
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: উত্তমকুমার, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, গৌরব চট্টোপাধ্যায়, রোশনি ভট্টাচার্য, লাবণী সরকার, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆
উত্তমকুমার! সেই চল্লিশের দশক থেকে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন এই মানুষটি। তিনি আছেন মানেই ছবি হিট। আজ সেই মানুষটি নেই, কিন্তু চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনের ভক্তিরস বিন্দুমাত্র কমেনি। বিভিন্ন অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে আজও তাঁর ছবি লক্ষ-লক্ষ ভিউ পায়। বর্তমান প্রজন্মও তাঁর বিভিন্ন ছবির দৃশ্য একাধিকবার স্মার্টফোনে, ল্যাপটপে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। ওদিকে ‘অটোগ্রাফ’ হোক বা ‘জাতিস্মর’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের (Srijit Mukherji) ছবিতে উত্তমকুমারের পরোক্ষ প্রভাব স্পষ্ট। এবার আরও একধাপ এগিয়ে বাঙালির একমাত্র ম্যাটিনি আইডলকে সৃজিত তাঁর ছবিতে নিয়ে এলেন। ‘অতি উত্তম’-এ (Oti Uttam) উত্তমকুমার (Uttam Kumar) হাঁটলেন, চললেন, হাসালেন, কাঁদালেন এমনকী টালিগঞ্জে তাঁর নিজের মূর্তি দেখে বিষণ্ণ মুখে চলেও গেলেন।
ছবিতে কৃষ্ণেন্দু (অনিন্দ্য) উত্তমকুমারের হাসির সামাজিক প্রভাব নিয়ে গবেষণারত। সে এই প্রজন্মের মানুষ হলেও তার হাবভাব, চালচলন অনেকটাই তার ‘গুরু’কে নকল করে। ইতিমধ্যে সে অতিআধুনিকা সোহিনীর (রোশনি) প্রেমে পড়েছে। তাকে প্রেমপ্রস্তাব দিতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত কৃষ্ণেন্দু পরবর্তী পরিকল্পনা করতে বসে গৌরবের সঙ্গে। বাস্তবের উত্তম-পৌত্র নিজনামেই ছবিতে অভিনয় করেছেন। দুই বন্ধু মিলে ঠিক করে, প্ল্যানচেটের মাধ্যমে খোদ উত্তমকুমারকে নামিয়ে তাঁর থেকেই পরামর্শ চাওয়া হবে, কীভাবে সোহিনীর সঙ্গে প্রেমটা জমানো যায়। প্ল্যানচেট সফল। উত্তমকুমার কথা দিলেন, তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে কৃষ্ণেন্দুর প্রেম সফল করবেন। কিন্তু সব কি আর এত সহজে হয়?
স্বীকার করতেই হবে, এক অসম্ভব মিলনকে দারুণভাবে সম্ভব করার জন্য ছবিতে উত্তমকুমারকে আনার প্রচেষ্টা অভিনব। তবে এ ছবি যেন এক দুর্বল কাহিনিকে দাঁড় করানোর জন্য খোদ রোম্যান্টিক হিরোদের গুরু উত্তমের শরণাপন্ন হওয়া। দুর্বল থেকে দুর্বলতর চিত্রনাট্যকেও একসময় উত্তমকুমার যেভাবে টেনে নিয়ে যেতেন, এ ছবির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু
প্রয়াত অভিনেতাকে পর্দায় আবার প্রকট করার জন্য এবং নিজের চিত্রনাট্য অনুযায়ী কথা বলানোর জন্য যে বিভিন্ন ছবি থেকে বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন বেশের উত্তমকুমারকে পর্দায় পেশ করতে হবে, তাঁকে সম্বোধনও যে ক্ষণে-ক্ষণে বদলে যাবে, সে ব্যাপারে পরিচালক খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে, প্রথমবার প্ল্যানচেটেই উত্তমকুমার দেখা দেওয়ার জন্য যে শর্তগুলি দেন, তাতেই এই গোলমালটির জোড়াতাপ্পি ছিল। কিন্তু ভবি তাতে ভুলবে কেন? উত্তকুমার আজ বেঁচে থাকলে, তাঁর নাম শুনেই বাঙালির পাগলামি দেখে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা দেখানোর প্রচেষ্টাটি নেহাত মন্দ না হলেও কাহিনি সেই নস্টালজিয়ায় মজে এগোলেই ব্যাপারটা বেশি ভালো হতো। সৃজিত তাঁর চিত্রনাট্যে এবং পরিচালনায় চেনা স্মার্টনেস বজায় রেখেছেন ঠিকই কিন্তু সেই মোচড়গুলি ছবিতে আলাদা কোনও মাত্রা যোগ করতে পারেনি।
কাহিনি ও চিত্রনাট্য ছাড়াও ছবির অন্যতম খামতির জায়গা হলো সৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ। যে সময়ে উত্তমকুমার অভিনয় করেছেন, তার তুলনায় বর্তমান চিত্রগ্রহণ পদ্ধতি বদলে গিয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। কাজেই, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল প্রস্তুত করার সময়ে আরও বেশি সাবধানী হওয়া প্রয়োজন ছিল। যে মানুষটিকে গোটা ছবিজুড়ে বিভিন্ন রূপে দেখা যাচ্ছে, তাঁর রোটোস্কপি বেশ কিছু দৃশ্যে রীতিমতো দৃষ্টিকটু লাগে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিতে গিয়ে উত্তমকুমারের কণ্ঠস্বর নকল করে এই ছবিতে বসানো হয়েছে। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই তা চট করে ধরা পড়ে যাচ্ছে বলে মনে হতে পারে। তাঁর এই কৃত্রিম কণ্ঠস্বরের ব্যাপারটি কেবলমাত্র ধূমপান সংক্রান্ত সতর্কতায় ব্যবহার করলেই ভালো হতো। এমনকী ছবির নাম যখন পর্দায় আসে, তখন ‘অতি’ যতটা ঝকঝকে, পুরোনো ছবির পোস্টার থেকে নেওয়া ‘উত্তম’ শব্দটিকে কি ততখানি ঝকঝকে করে তোলা যেত না? প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে—যার অন্যতম প্রধান কারণ বাজেট—বাংলা ইন্ডাস্ট্রি অনেক পিছিয়ে। তবু ভিএফএক্সের কাজ আরও একটু নিখুঁত হলে ভালো লাগত। প্রণয় দাশগুপ্তের সম্পাদনা আরও টানটান হতে পারত। কাহিনির মেদ কমালে সমানুপাতে ছবির দৈর্ঘ্য কমলেও ধৈর্যচ্যুতি ঘটত না।
মন্দভালোর মধ্যে অন্যতম প্রাপ্তি অভিনয়। সবার আগে বলতে হয় অনিন্দ্যর কথা। ছবির নায়ক, গুণমুগ্ধ ভক্ত, ব্যর্থ প্রেমিক সবরকম ভূমিকাতেই তিনি নিজের সেরাটুকু দিয়েছেন। গৌরবের তরফ থেকে প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। নবাগতা হিসেবে রোশনি তাঁর ভূমিকায় যথাযথ। কৃষ্ণেন্দুর বাবা-মায়ের ভূমিকায় শুভাশিস ও লাবণীর বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবু নিজেদের ভূমিকাটুকু তাঁরা যথাযথভাবেই পালন করেছেন।
আরও পড়ুন: মধুবালার বায়োপিক
আর যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি শারণ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তমকুমারের দৃশ্যগুলিতে সবুজ ক্রোমা পোশাক পরে অভিনয় করেছেন তিনিই। তাঁকে দেখেই অন্য শিল্পীরা তাঁদের সংলাপ বলেছেন। উত্তমের শরীরীভাষা রপ্ত করতে হয়েছে তাঁকে, এটা জেনেও যে শেষমেশ তিনি ছবিতে থাকবেন না। কুর্ণিশ প্রাপ্য তাঁর।
ছবির অন্যতম আকর্ষণ সপ্তক সানাই দাসের সঙ্গীত এবং প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ। প্রতিটি গানই কানে লেগে থাকার মতো। বিশেষ করে সৃজিতের কথায়, উপল সেনগুপ্তের কণ্ঠে ‘এখনও তো সেই তোমাকেই বন্ধু ভাবি’ শুনতে দুর্দান্ত লাগে। এ গানে উত্তমকুমার অভিনীত ১৬টি ছবির নাম ব্যাবহার করেছেন সৃজিত। রম-কম ছবির আবহ হিসেবে প্রবুদ্ধর কাজ ভালো।
সব মিলিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে একবার দেখেই আসা যায় ‘অতি উত্তম’। আর কিছু না হোক, খোদ উত্তমকুমার তো আছেন এ ছবিতে, ‘ইজ়ন্ট দ্যাট এনাফ?’