ঐতিহ্যের পুজো: রানী রাসমণি

বনেদি বাড়ির পুজোর আবহে সাবেকিয়ানা জড়িয়ে থাকে। থাকে ঐতিহ্যের রূপ, রস, গন্ধ। তাই বনেদি বাড়ির পুজো দেখতে যাওয়া মানেই স্মৃতি মেদুরতায় আচ্ছন্ন হওয়া। কতরকম আশ্চর্য অদ্ভুত গল্প যে বনেদি বাড়ির হাওয়ায় ওড়ে; আর এসব গল্পই বাড়ির পুজোকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে। তবে বনেদি বাড়ি মানেই কিন্তু শুধু বাবু কালচার আর টাকা ওড়ানোর গল্প নয়। অনেক ইতিহাসও জড়িয়ে থাকে বারান্দার খিলানে, ঠাকুর দালানের কড়িকাঠে বা নাচঘরের ঝাড়বাতিতে। রানী রাসমণির বাড়ির পুজোয় তেমনই এক ইতিহাস আর আভিজাত্যের মেলবন্ধন ।

মাত্র ১১ বছর বয়সে রাসমণির বিয়ে হয় ঠনঠনিয়ার জমিদারপুত্র রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে। কথিত আছে এ বাড়ির দুর্গাপুজোর প্ৰতিষ্ঠা করেন রাসমণির শ্বশুর প্রীতিরাম দাস। তাঁর পরে এই পুজোর দায়িত্ব সামলান রাজচন্দ্র ও রাসমণি। এঁদের চার কন্যা ছিল।

রানীর নিজের কর্মকান্ডের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়িরও অনেক ইতিহাস রয়েছে। জানা যায়, জানবাজারের প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরী হয়েছিল আট বছর ধরে। ১৮১৩ থেকে ১৮২০। সেই যুগে ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল এই বাড়ি তৈরী করতে। সেই প্রাসাদে একটি পুকুর, ছয়টি উঠান ও ৩০০ মিটারের বিশালাকার শয়নকক্ষ ছাড়াও ঠাকুর দালান, নাটমন্দির, কাছারিবাড়ি, দেওয়ানখানা, গোশালা, অশ্বশালা, ফুলের বাগান আরও না জানি কত কি। এই বাড়ি ছিল অধুনা ৭১ মির্জা গালিব স্ট্রীট, তথা পূর্বতন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। পরে আরও তিনটি ঠিকানায় ভাগ হয়ে যায় এই বংশের উত্তরাধিকারীরা। প্রথম দুর্গাপুজো হয় মূল কাছারিবাড়ি অর্থাৎ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাড়িতেই। বর্তমানে এটির তত্বাবধানে রয়েছেন হাজরা পরিবার।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

এই প্রসঙ্গে রানী রাসমণির কথা এসেই যায়। তাঁর দক্ষিনেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা সে যুগের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইংরেজ জমানায় পুরুষশাসিত সমাজে রানীর প্রবল প্রতাপ যথেষ্ঠ প্রশংসনীয় ছিল। ১৮৪৭ সালে একবার রানী স্থির করেন কাশী যাবেন। সঙ্গে আত্মীয় পরিজন ভৃত্যস্থানীয়রা মিলে ২৪টি নৌকা প্রস্তুত হয়। সেই রাতে রানী স্বপ্ন দেখেন মা কালী তাঁকে বলছেন বিদেশে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই। গঙ্গার ধারে মন্দির নির্মাণ করে তাঁর পুজো করলেই তিনি তুষ্ট হবেন। রানী উদ্যোগ নেন মন্দির নির্মাণের। ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৫, দীর্ঘ আট বছরে তৈরী হয় দক্ষিনেশ্বর কালী মন্দির। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে মা ভবতারিনীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন রানী। কামারপুকুর থেকে শ্রী রামকুমার চট্টোপাধ্যায় আসেন প্রধান পুরোহিত হয়ে। পরে এই মন্দির ঘিরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মাহাত্ম্য প্রচার হয় দেশের বিভিন্ন  ক্ষেত্রে। তবে এ কাহিনী প্রায় সকলেরই জানা।




ফিরে আসি রানী রাসমনির বাড়ির পুজোয়।

রাজচন্দ্রর মৃত্যুর পরে রানী এই পুজোর দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন। রানীর আমলে খুব ধুমধাম করে এই পুজো করা হতো। সারারাত ব্যাপী যাত্রা, কবিগানের আসর বসতো। এই বাড়িতে প্রখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা ও এন্টনি ফিরিঙ্গিও এসেছেন বলে শোনা যায়। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও পরে রবীন্দ্রনাথও এসেছেন এই বাড়ির পুজো দেখতে। একবার স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ সখীর বেশে এই বাড়ির পুজোয় এসে চামর দুলিয়ে যান, কেউ তাঁকে চিনতে পারেননি। ১৮৬১ সালে রানীর মৃ্ত্যু হয়। তার আগে তিনি তাঁর বাড়ি ও সমস্ত সম্পত্তি জামাতা মথুরমোহন বিশ্বাস ও অন্য জামাতাদের মধ্যে দান করে যান। সেই থেকে তিনভাগে এই বাড়ির পুজো হয়ে আসছে। আগে পশুবলির চল থাকলেও ১৯০৩ সাল থেকে তা তুলে দেওয়া হয়।

রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

সেই পূর্বের জৌলুস যদিও আর নেই, তবু নিষ্ঠার অভাব ঘটে না পুজোয়। বৃহৎ নান্দিকার পুরাণ মেনে এ বাড়ির পুজো হয় বলে জানা যায়। প্রতিপদ থেকে পুজো শুরু হয় এবং তা চলে নবমী অবধি। এ বাড়ির কুমারী পূজা বিখ্যাত। প্রতিমা হয় সাদা ডাকের সাজে এবং চোখ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ বড় হয়। পুজোর কদিন এ বাড়িতে সবার জন্য অবারিত দ্বার। মা দূর্গাকে ভোগে লুচি, ভাজা, লেডিকেনি, খাজা ও গজা দেওয়া হয়। পরে এই ভোগ প্রসাদরূপে ভক্তদের মধ্যে বিলি করা হয়। এ বাড়ির সিঁদুর খেলাও পুজোর একটা বড় আকর্ষণ।

নাই বা থাকল সেই জৌলুস, নাই বা থাকল সেই জাঁকজমক। তবু তিন জায়গায় ভাগ হয়ে গেলেও আজও রানী রাসমণির সেই আভিজাত্য ও ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে এই বংশের পুজো, যা এখনও দর্শনার্থীদের কাছে এক অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
171

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

2 thoughts on “ঐতিহ্যের পুজো: রানী রাসমণি

  • Khubiii sundor likhechis… Khub bhalo laglo

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *