ঐতিহ্যের পুজো: শীলবাড়ি

কলকাতা শহরের ঐতিহ্য তার নিজস্বতায়, তার চলনে বলনে, তার সংস্কৃতিতে, তার উৎসবে অনুষ্ঠানে, তার সাবেকিয়ানায়। আর কলকাতার ইতিহাস বলতে হলে অবধারিতভাবে এসে পড়ে আজও টিকে থাকা গুটিকয়েক সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারের পুজোর কথা। যেখানে হয়তো আজ আর সেই জাঁকজমক, সেই আড়ম্বরের অহঙ্কার নেই, তবু নিষ্ঠা আন্তরিকতা আর ভক্তির ছোঁয়ায় এখনও প্রতিবছর পুজোর পাঁচটা দিন সারা পরিবারের মিলনমেলার সাক্ষী হয়ে থাকে প্রাচীন ঠাকুরদালান।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কলুটোলা অঞ্চলে নিজের বাড়িতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী মতিলাল শীল প্রথম দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। তিনি ছিলেন বাগনান, মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা এবং বাংলাদেশের কিছু অংশের জমিদার। সমাজসেবায় সেকালের পরিচিত নাম মতিলাল, সেই ব্রিটিশ আমলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজকে নিজের বাসস্থানের কাছে বিশাল জমি দান করেন। চিকিৎসার পরিসেবায় নিজে থেকে বাড়িও তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই পুজোর আজ প্রায় ২০০ বছর হতে চললো। এখন পুজো করেন মল্লিকরা। মতিলাল শীলের ছোট ছেলে কানাইলাল শীল এই বাড়ির উত্তরাধিকার ছিলেন। তাঁর পুত্র গোপাললালের কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় ভাগ্নেরা এ বাড়ির উত্তরাধিকারী হন। তারাই বর্তমানে শরিকি প্রথায় পুজোর ভার বহন করে চলেছেন। প্রতিবছর পুজোয় লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়।

প্রতিটি অভিজাত বংশের মতোই শীলবাড়ির পুজোতেও কিছু নিজস্ব রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান আছে যা এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়। উল্টোরথের দিন গরান কাঠের কাঠামো পুজো করে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয়। পুজো শুরু হয় আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে। ষষ্ঠীর সকাল পর্যন্ত বাড়ির পিছনের বেলগাছকে পুজো করার নিয়ম রয়েছে। ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় একচালার দেবীমূর্তির আরাধনা। অষ্টমীর সকালে ধুনো পোড়ানো এই বাড়ির অন্যতম প্রাচীন রেওয়াজ। বাড়ির মহিলারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন। সন্ধিপুজোয় ঠাকুরের সামনে দেওয়া হয় ঠিক এক মণ চালের নৈবেদ্য। এটাই নিয়ম। যেহেতু বৈষ্ণব মতে পুজো হয় তাই পশুবলি হয়না। তার বদলে ছাঁচিকুমড়ো ও আখ বলি হয়। এ বাড়ির আরও একটি বিশেষত্ব হলো পুজোর কটা দিন বাড়ির বউদের নাকে নথ ও পায়ে মল পড়া বাধ্যতামূলক। তাই এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে এলে বাপের বাড়ি থেকে নাকের নথ দিতেই হয়।

ভোগে নানান মিষ্টান্নের সঙ্গে বাটা চিনি দেওয়ার নিয়ম আছে। নবমীর রাতে ব্রাহ্মণ বিদায় করা হয়। একসময় প্রচুর ব্রাহ্মণকে ভোগ ও দক্ষিণা দিয়ে বিদায় করা হতো। এখন সেই সংখ্যা কমতে কমতে দশ পনেরোয় এসে দাঁড়িয়েছে। নবমী পুজোর পরে এঁদের কাঁসার থালায় বাটা চিনির ভোগ ও দক্ষিণা দিয়ে বিদায় দেওয়া হয়ে থাকে।

আজও দুর্গাপুজো উপলক্ষে সমস্ত আত্মীয়স্বজনরা আসেন। সকলে মিলে এই পাঁচদিন আনন্দ করাই এই বাড়ির রীতি। দশমীতে সিদ্ধিপানের নিয়ম বহু পুরোনো। একসময় নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে কৈলাশে খবর দেবার নিয়ম থাকলেও এখন সরকারি নিয়মের কারণে সেই প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে দশমীতে প্রতিমা কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু ১৯৪৬ এর দাঙ্গার পর সেই নিয়ম পাল্টানো হয়। গঙ্গায় আর্মেনিয়ান ফেরীঘাটের পাশে শীলবাড়ির নিজস্ব ঘাট রয়েছে। সেখানে প্রথম শীলবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জন করাই নিয়ম। তারপরে অন্য প্রতিমা বিসর্জন হতে পারে। আগে দু নৌকো বেঁধে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হতো। এখন তা আর হয়না। বিসর্জন শেষে বাড়ির সকলে ঠাকুরদালানে জড়ো হন। বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বাড়ির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ কর্তাকে। এইভাবে একে একে সকলের প্রণাম ও কোলাকুলির মাধ্যমে অভিনব বিজয়া পালন করেন শীলবাড়ির সদস্যরা।

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
7

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

One thought on “ঐতিহ্যের পুজো: শীলবাড়ি

  • Subho Bijoya

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *