ঐতিহ্যের পুজো: সাবর্ণ রায়চৌধুরী
প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অধিকাংশই উত্তর কলকাতায়। কিন্তু কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো পুজোটি এই ব্যাপারে ব্যতিক্রম। কলকাতা শহর পত্তনের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছিল কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপুজো। আর তা হয়েছিল দক্ষিণের বড়িশায়। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বড়িশার কাছারি বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো করেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, সাবর্ণ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে যে বংশের নাম।
দেখতে দেখতে ৪০৭ বর্ষে পা রাখল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো। সময়টা ছিল এই কলকাতা শহর পত্তনেরও আগে। সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা, ছিল তিনটি গ্রাম। সেই আমলে ১৩০০ টাকায় এই তিন গ্রামের প্রজাস্বত্ব হস্তান্তরিত করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে। এই তিন গ্রামের স্বত্ব ছিল লক্ষ্মীকান্তর হাতে। মূল নিবাস ছিল হালিশহরে।
প্রথম জীবনে লক্ষ্মীকান্ত ছিলেন বারো ভূঁইয়ার অন্যতম যশোহরের জমিদার প্রতাপাদিত্যের দরবারের এক কর্মচারী। সেখানে তিনি ‘মজুমদার’ পদে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে প্রতাপের পতনে মুঘল বাহিনীর সহায়তা করে রাজা মানসিংহের সুপারিশে সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে পান বিরাট জমিদারি ও ‘রায়চৌধুরী’ খেতাব। সেই থেকে লক্ষ্মীকান্তরা বংশানুক্রমে রায়চৌধুরী পদবি ব্যবহার করো আসছে।কথিত আছে, পরবর্তীকালে সম্রাট আওরঙ্গজেব এই বাড়ির পুজোয় উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। সাবর্ণ গোত্রীয় হওয়ার কারণে এই পরিবারকে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বলা হয়ে থাকে।
লক্ষ্মীকান্তর আদি নিবাস হালিশহরে হলেও জমিদারীর সুবিধার জন্য তিনি বড়িশায় কাছারি বাড়ি ও বাসস্থান নির্মাণ করেন। ১৬১০ সালে প্রথম আটচালা মণ্ডপে দুর্গাপুজো শুরু হয়। প্রথম আটচালাটি ছিল কাঠের থামের ওপর হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া চন্ডীমণ্ডপের মতো। পরে কংক্রিটের আটচালা তৈরি হয়। আটচালার লাগোয়া ষোলটি থামবিশিষ্ট একটি নাটমন্দিরও ছিল। সেই নাটমন্দিরের ছাদ ভেঙে পড়ে বহুকাল আগে। রয়ে গেছে মোটে দশটি থাম। সাবর্ণ পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী পুজো হয় আটচালাতেই। ঠাকুরদালানে নয়।
এই পরিবারে কবি বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী মতে পুজো হয়ে থাকে। সমগ্র রায়চৌধুরী পরিবার মিলিয়ে মোট আটটি পুজো হয়। এর মধ্যে ছ’টি পুজো বড়িশায় হয়। এগুলি হলো ‘আটচালাবাড়ি’, ‘বড়বাড়ি’, ‘মেজবাড়ি’, ‘মাঝের বাড়ি’, ‘বেনাকিবাড়ি’ আর ‘কালীকিঙ্করভবন’। এছাড়া আরো দুটি পুজো হয় বিরাটি ও নিমতার বাড়িতে। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে দেবীর বোধন হয়। তারপর ১৫ দিন ধরে পুজো চলে। প্রতিদিন চন্ডীপাঠ, আরতি ও ভোগ নিবেদন হয়।
পঞ্চমীর দিন পঞ্চদেবতা, যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, গণেশ ও শান্তির পুজো করা হয় ঘটে। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় রাধাকান্ত মন্দিরের বোধনঘরে আবার বোধন হয় মা দুর্গার। দুর্গার একদিকে থাকেন দেবাদীদেব মহাদেব ও অন্যদিকে রঘুবীর শ্রী রামচন্দ্র। দেবীর গায়ের রঙ শিউলি ফুলের বোঁটার মতো কমলা। সিংহের মুখাবয়ব কোনও বাড়িতে ঘোটকাকৃতি আবার কোথাও সিংহের মতো। গায়ের রঙ হয় সাদা। আগে নিমতার বাড়ি ছাড়া আর সমস্ত বাড়িতে ১৩টি পাঁঠা ও একটি মোষ বলি হতো। এখন পশুবলি নিষিদ্ধ। তার বদলে ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়া হয়।
সপ্তমীর সকালে দেবীর চক্ষুদান ও নবপত্রিকা স্নান দিয়ে পুজো শুরু হয়। দেবীমূর্তির সামনে সোনার আংটি ও সোনার আসন রেখে মহাসপ্তমী ও মহানবমীর পুজো হয়। সন্ধিপুজোয় দেবী চামুন্ডা রূপে পূজিত হন। দেবী ও অন্যান্য দেবতাদের জন্য তিনরকম ভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। নিরামিষ ভোগ হয় মহাদেব ও রামচন্দ্রের জন্য ও আঁশ ভোগ হয় দেবী দুর্গার জন্য। সন্ধিপুজোয় ল্যাটামাছ পোড়ানো এই বাড়ির প্রথা। দশমীর দিন পান্তাভাত, কচুর শাক, অড়হর ডাল ও চালতার চাটনি দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের পর দেবীমূর্তির সামনেই বিজয়াপর্ব সারার নিয়ম এই বাড়িতে। আগে আদিগঙ্গায় বিসর্জন হলেও এখন বাবুঘাটে বিসর্জন হয়ে থাকে।
Mon chuea galo… Darun… 🙂
Khub e bhalo laglo.