পুজোর ছবি, ছবির পুজো

রাজনীতি এবং খেলা বাদ দিলে বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় আলোচনার বিষয় বোধহয় দুর্গাপুজো। বাকিগুলো যদিও সারা বছরের, তবে দুর্গাপুজো বাৎসরিক, তাই একটু বেশিই স্পেশাল। পুজোর খাওয়া, পুজোর বেড়ানো, পুজোর জামাকাপড়, পুজোর সাজ, পুজোর গান এবং পুজোর সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসে না এমন বাঙালি বিরল। তেমনই এক আলোচনা রইল আজ আমাদের পাতায়। তবে এখানে পুজোর সিনেমা বা ছবি বলতে পুজোর মুখে মুক্তি পাওয়া ছবি নয়, বরং যে সমস্ত ছবিতে দুর্গাপুজো দেখা গিয়েছে তার কথাই উঠে আসবে। বছরের যে কোনও সময় দেখলেই এই ছবিগুলো যেন মনে আনন্দের ছোঁয়া দিয়ে যায়। আজ তেমন কিছু ছবির কথা আলোচনা করা যাক যেগুলোয় স্পষ্টভাবে পুজোর প্রসঙ্গ এসেছে। আবার ছবির গল্পে পুজোর প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও আলোচনা চলতে পারে। 

জয় বাবা ফেলুনাথ: ছবিতে দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গের কথা বলতে প্রথমেই মাথায় আসে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর। না, ‘দেবী’ নয়। কারণ দুর্গাপুজো  বাঙালির কাছে ঠিক ধর্ম পালন নয়। বরং সব অর্থেই তা উৎসব। ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে যেভাবে পুজোর সময় বেড়াতে যাওয়া আর তারপর এক বনেদি বাড়িতে গনেশ মূর্তি চুরির ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে, তাতে প্রথম দৃশ্য থেকেই পুজোর সুরটা খুব সুকৌশলে বেঁধে দেওয়া হয়। ঠাকুর তৈরি বা রং করা এমন এক দৃশ্য যা দেখে বাঙালি স্বভাবতই আপ্লুত হয়। তাই রুকুর সঙ্গে শশীবাবুর কথোপকথন বাংলা ছবির কাল্ট দৃশ্য হয়ে রয়ে গিয়েছে। এছাড়া ছবির মূল ঘটনা যেভাবে দুর্গা মূর্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাতে এই ছবিতে পুজোর প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। 

দাদার কীর্তি: এই প্রসঙ্গে আরও একটি কালজয়ী ছবির কথা বলতেই হয়। পরিচালক তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’, মুক্তি পায় ১৯৮০ সালে। কলকাতা থেকে বিহারের কোনও এক বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে কাকার বাড়িতে থাকতে আসে কেদার। সেখানে দুর্গাপুজো ও একটি বাঙালি ক্লাবকে কেন্দ্র করে কেদারের জীবনে নানা পরিবর্তন আসে। ‘দাদার কীর্তি’তে পুজোর দৃশ্য কম থাকলেও পুজোকে ঘিরে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় তা ছবির মূল বিষয় বলা যেতে পারে। শারদোৎসবকে ঘিরে বাঙালীর নস্ট্যালজিয়াকে উস্কে দিয়ে যায় এই ছবি।

আরও পড়ুন: ফিরছেন ভাদুড়িমশাই, এবারও চিরঞ্জিত

অনুসন্ধান: এটি একটি দ্বিভাষিক ছবি। ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পরিচালক শক্তি সামন্তর এই ছবিতে পুজোর দৃশ্য না থাকলেও কিছু এসে যেত না। তবু কালিরামের ঢোল ফেটে যাওয়া, বাংলার সুপারস্টার জামাইয়ের বিখ্যাত নাচ এবং বাঙালি নায়িকা এই ত্রহ্যস্পর্শ যোগের কারণেই বোধহয় ‘অনুসন্ধান’ ছবিতে দুর্গাপুজোর দৃশ্যটা প্রায় সকলেরই প্রিয়। 

উৎসব: এবার অনেকটা এগিয়ে আসা যাক। ২০০০ সাল। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ তখন পরিচিত নাম। এর আগে ১৯৯২ সালে যে ছবি দিয়ে তাঁর পরিচালনায় হাতেখড়ি হয়েছিল সেই ‘হীরের আংটি’তেও পুজোবাড়ির গল্প ছিল। কিন্তু সব মিলিয়ে ছবিতে পুজোর আবহ তেমনভাবে টের পাওয়া যায়নি। সেই খামতি ঋতুপর্ণ পূরণ করে দিলেন আট বছর পর। মুক্তি পেল ‘উৎসব’। মফস্বলের এক বনেদি পরিবারের অতি কষ্টে টিকিয়ে রাখা পুজো ও ভেঙে পড়া সম্পর্কের গল্প বললেন পরিচালক। বাড়ির পুজোটাই এখানে ছবির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। অর্থাৎ পুজো ছাড়া এই গল্পটাই হয়ে উঠত না। কলকাতায় থাকা ছেলেমেয়েরা সকলে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ও পুজো কাটাতে বছরের এই একটা সময়েই বাড়ি আসে। সারাবছর ধুলো জমা সম্পর্কগুলোয় পড়ে আদর যত্নের প্রলেপ। বাঙালীর চিরকেলে কিছু নস্ট্যালজিয়াকে উস্কে দিয়েছিল এই ছবি। এখনও পুজোর আশেপাশের সময়ে এই ছবি দেখতে বসে পড়া যায়। সারা ছবিতে পুজোর গন্ধ যেন ম-ম করে। 

আরও পড়ুন: খলচরিত্রে রণবীর, ঘোষণা জন্মদিনে

বিসর্জন: ২০১৭ সালে মুক্তি পায় পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিসর্জন’। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এক গ্রামে দুর্গা বিসর্জনের পরের দিন এক তরুণকে অচৈতন্য অবস্থায় খুঁজে পায় বাংলাদেশের মেয়ে পদ্মা। সেদিক থেকে দেখলে এই ছবি শুরু হচ্ছে পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু ভারত থেকে আসা নাসেরের সঙ্গে বিধবা পদ্মার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর তার শেষ যেভাবে হয় সেখানে কীভাবে যেন গঙ্গায় ডুবে যাওয়া প্রতিমার মুখের সঙ্গে পদ্মার মুখ একাকার হয়ে যায় দর্শকের মনে। ঠিক যেমনটা ছবির পোস্টারে দেখা গিয়েছিল। বস্তুত দুই ভিন্নধর্মী ও ভিন্ন দেশের বাসিন্দার মধ্যে এমন মন ছুঁয়ে যাওয়া সম্পর্কের গল্প ছবিটিকে নিছক সেলুলয়েডের সৃষ্টিতে আটকে না রেখে যেন কবিতায় উত্তীর্ণ করেছিল। এই ছবিতে প্রত্যক্ষভাবে দুর্গাপুজো নেই, কিন্তু তবু ওই জলের ওপরে ভেসে থাকা প্রতিমার মুখের শেষ ঝলকটুকু এ ছবির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। 

উমা: এই ছবিটি তার গল্পের অভিনবত্বের জন্য স্মৃতিতে থেকে গেছে। ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘উমা’। প্রবাসী বাবা-মেয়ের এই কাহিনিতে দুর্গাপুজো নিজেই একটা চরিত্র। বিদেশে থাকা ছোট্ট উমার আবদার মেটাতে তার বাবা এক অকাল দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন কলকাতা শহরে। উমা যে আর বেশিদিন বাঁচবে না, তাই তার শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে জান প্রাণ লড়িয়ে দেয় কতগুলো মানুষ। উমার কলকাতার পুজো দেখার স্বপ্ন সার্থক হয়। অকালে হলেও উমার বাবা ও তার সঙ্গীদের লড়াইয়ে কোথায় যেন দর্শকও সামিল হয়ে যান, উমাকে পুজো দেখাতেই হবে। 

আরও পড়ুন: হস্টেজ থ্রিলারকে টেক্কা দিয়ে গেল কঠিন বাস্তব

দুর্গা সহায়:  ২০১৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল পরিচালক অরিন্দম শীলের ছবি ‘দুর্গা সহায়’। এই ছবিতে বাড়ির পুজোকে সামনে রেখে ছোটবউ মানসীর সঙ্গে বাড়ির পরিচারিকা দুর্গার এক অনবদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখা যায়। বাড়ির পুজোর আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সকলের আনন্দকেও তুলে ধরা হয়েছিল ছবিতে। পুজো চলাকালীন বাড়ির ছোটদের হইচই গানবাজনা সব মিলিয়ে দুর্গাপুজোর আবহ এই ছবির পরতে-পরতে ঠাসা রয়েছে। 

কাহানি: দুর্গাপুজোকে ঘিরে তৈরি ছবির  ছবির তালিকায় এই ছবির নাম আসতে বাধ্য, যদিও ছবিটি বাংলা নয়। ২০১২ সালে মুক্তি পায় পরিচালক সুজয় ঘোষের হিন্দি ছবি ‘কাহানী’। এই ছবির প্রেক্ষাপট ছিল কলকাতা। দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে বিদ্যা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় একা কলকাতায় আসে তার বাঙালি স্বামীকে খুঁজতে। গোটা ছবি জুড়ে চলে তার খোঁজার জার্নি। এই ছবির ক্লাইম্যাক্স বিজয়া দশমীর দিন, ঠাকুর বিসর্জনের ভিড়ের মধ্যে। আরও বহু হিন্দি ছবিতেই বাংলার দুর্গাপুজো উঠে এসেছে। তবু এই ছবিটার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ কলকাতাকে অন্যভাবে চিনিয়েছিল ‘কাহানী’। শুধু দুর্গাপুজো নয়, বাংলার নানা কালচার এবং বাঙালি তথা কলকাতার মানুষ এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বেশ কিছু মনে রাখার মতো চরিত্র দিয়েছে এই ছবি, সঙ্গে বাঙালিকে দিয়েছে সারা বিশ্বের কাছে কলকাতাকে চেনাবার মোক্ষম কিছু দৃশ্য। তাই কলকাতা, দুর্গাপুজো আর সিনেমার কথা উঠলে এই ছবিটার প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। 



একান্নবর্তী: এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ২০২১-এ মুক্তি পাওয়া মৈনাক ভৌমিকের ছবি ‘একান্নবর্তী’। প্রায় বিক্রি হতে চলা একটি বনেদি বাড়ির পুজোয় তার ছবির শুট করতে আসেন এক পরিচালক। একই সময়ে বাড়ির মেয়ে ও দুই নাতনিও আসে দিদার সঙ্গে ছুটি কাটাতে। একটা পুজো কীভাবে অনেকগুলো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়ে নতুন করে বাঁচতে শেখায় সেই নিয়েই ছবির কাহিনী। বলা বাহুল্য দুর্গাপুজো এই ছবিতে নিজেই একটা চরিত্র। 

২০০০-এর পরে বেশ কিছু বাংলা ছবিতে উঠে এসেছে পুজোর দৃশ্য পুজো নিয়ে গান। তার মধ্যে ২০১২-এর ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’ ছবিতে জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুরে, অভিজিত ভট্টাচার্যের গাওয়া ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’ গানটির কথা বলতেই হয়। অনেকের মতে চটুল হলেও বিসর্জনের দিন এমন গানেই বাঙালি চিরকাল পায়ে পা মিলিয়েছে। গানটির জনপ্রিয়তা আজও একইরকম। এছাড়াও বহু ছবিতে দুর্গাপুজোর দৃশ্য এসেছে, যে ক’টা মনে পড়ল লিখলাম। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *