মশলা ছবি নিজ গৌরবে হাজির
সিনেমা: খাদান
পরিচালনা: সুজিত দত্ত
অভিনয়ে: দেব, বরখা বিস্ত, ইধিকা পাল, যিশু সেনগুপ্ত, অনির্বাণ চক্রবর্তী, স্নেহা বসু, জন ভট্টাচার্য, সুজন মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆
নব্বইয়ের দশক থেকে যে মারকাটারি অ্যাকশন ছবি বাঙালি দেখে এসেছে, বেশ কিছু বছর হলো, তা যেন হারিয়েই গিয়েছে। তার বদলে বিভিন্ন ছবির বিষয়বস্তু হয়ে চলেছে পারিবারিক ড্রামা বা নতুন বোতলে পুরোনো মদ ঢেলে বানানো থ্রিলার। বাজারের সেই দাবির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে একসময়ের মশলা ছবি পরিবেশন করা নায়করাও এখন পারিবারিক ছবিতে মন দিয়েছেন। তবু সেখান থেকেই কিছুটা আবার মশলা ছবিতে ফিরেছেন দেব। খাদান দেখতে বসে মনে পড়ে যায় পুরোনো অ্যাকশন তারকা দেবের কথা।
খাদান (Khadaan) শুরু হয় সব্যসাচী চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বরে খাদানের বর্ণনা দিয়ে। জানানো হয়, শ্যাম মাহাতো (দেব) এবং মোহনদাস (যিশু) নিজেদের ক্ষমতা আর বুদ্ধি দিয়ে কয়লাখনির এই সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল। একে-একে আসে অন্যান্য চরিত্রেরা, বিধায়ক সিদ্দিকি (সুজন), তার প্রতিপক্ষ এবং শ্যাম-মোহনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া যমুনা (বরখা) ও রেখা (স্নেহা)। এদিকে কয়লাখনি প্রতিষ্ঠার সময়ে শ্যামের সঙ্গে বিবাদ লাগে বলাই মান্ডির (অনির্বাণ)।
পরে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, শ্যামের জন্য প্রাণ দিতেও পিছপা নয় মান্ডি। অচিরেই সব মানুষদের মধ্যে সর্দার এবং মসিহা বলে পরিচিত হয় শ্যাম। কিন্তু সব উত্থানেরই পতন থাকে। একটি মারপিটের সময়ে ভুল করে এক পুলিশকর্মীকে হত্যা করে শ্যাম। সেই অভিযোগে হাজতে থাকার সময়েই একদিন রহস্যময়ভাবে তার ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায়। এরপর কয়েক দশক কেটে যার এবং পর্দায় আসে শ্যামের ছেলে মধু (দেব)। সে আবার বাপকে খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু শ্যামের রহস্যময় মৃত্যুর কারণ কী? মধু কি তাহলে সিন্ডিকেটে যোগ দেবে না। এরকম নানা প্রশ্ন নিয়ে এগোতে থাকে কাহিনি। আসে মধুর প্রেমিকা লতিকা (ইধিকা) এবং মোহনের ছেলে মাখন (জন)। অবশেষে দুষ্টের দমনের মাধ্যমে শেষ হয় ছবি।
আরও পড়ুন: বাস্তুচ্যুত প্রান্তজন, নর্মদা ‘পরিক্রমা’য় দেখালেন গৌতম
ছবির পরিচালক তথা কাহিনিকার সুজিৎ খুব ভালো করে জানেন, মশলা ছবিতে গল্প নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামালেও চলে। কেবল প্রথমার্ধ জট পাকাতে এবং দ্বিতীয়ার্ধ জট ছাড়াতে পারলেই হলো। তার সঙ্গে একটু কমেডি, কয়েকটা গান, চেজ় সিকোয়েন্স, আগুন, আইটেম সং, একেবারে পুলক ঘোষালের ফর্মুলা যাকে বলে। সেই ফর্মুলা বজায় রাখতে তিনি সম্পূর্ণ সফল! তার সঙ্গে বিশ্বরূপ বিশ্বাসের সংলাপের আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। শ্যামের মুখে ‘ফ্যামিলি নিয়ে ব্যস্ত আছিস বলে কী ভেবেছিস, অ্যাকশনটা ভুলে গেছি? ওটা আমারই কাজ’-এর মতো সংলাপের মাধ্যমে দেব যেন সব সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বার্তা দেন। নায়ক এবং খলনায়কের অন্যান্য সংলাপও যেন একেকটা ধারালো চাক্কু! সোজা দর্শকদের বুকে বিঁধে হলে একেবারে পায়রা উড়িয়ে দিতে পারে।
আরও পড়ুন: বাজিকা ভাষায় প্রথম ছবি, সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন আরিয়ান
অভিনয়ের দিক থেকে বলা যায়, এই ছবি দেবসর্বস্ব। তার অ্যাকশন, লুক, স্টাইল, নাচ, এসবের জন্যই দর্শক হলে যান। তার পাশাপাশি যিশুও যথাযথ সঙ্গত দিয়েছেন। যথার্থই তবলার ডাঁয়া এবং বাঁয়া বলা চলে তাঁদের। মান্ডির ভূমিকায় অনির্বাণ চেষ্টা করলেও সেই চরিত্র বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি। আলাদা করে বলতে হয় গোকুলদাসের চরিত্রে পার্থ সারথীর কথা। চিরকাল নায়কের কমিক সাইডকিক হয়ে রয়ে যাওয়া এই অভিনেতার দৃষ্টিই রক্ত জল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বরং ছবির দুই নায়িকা বরখা এবং ইধিকা, উভয়েই সামান্যতম ছাপ ফেলতেও ব্যর্থ। ইধিকার অভিনয়ে এখনও টিভি সিরিয়ালের ছাপ স্পষ্ট। বরখারও বিশেষ কিছু করার ছিল না। জন তাঁর নিজের ভূমিকা পালনে যথাযথ।
খাদানের অন্যতম আকর্ষণ তার অ্যাকশন গান এবং আবহ। নীলায়ন চট্টোপাধ্যায়, রথিজিৎ ভট্টাচার্য ও স্যাভি গুপ্তকে টুপিখোলা কুর্নিশ দেওয়াই যায়। রক্ত গরম করে দেওয়ার মতো সুর, তার সঙ্গে শৈলেশ অবস্তীর দুর্ধর্ষ চিত্রগ্রহণ দর্শককে মাতিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। মহম্মদ কালামের সম্পাদনাও যথাযথ।
ছবির শেষে টু বি কন্টিনিউড দেখে একটু হতাশই লাগে। সামান্য দীর্ঘ হলেও এক ছবিতেই কাহিনি শেষ করা উচিত ছিল। কারণ, হাজার হোক, একই চমক আবারও দিলে তাতে দর্শকের আশা থাকে অনেক বেশি এবং পান থেকে চুন খসলেই ধেয়ে আসে সমালোচনা। মোটের ওপর অনেকদিন বাদে ফ্যামিলি ড্রামার মাঝে বড়পর্দায় মশলা ছবি নিজ গৌরবে হাজির। একবার হলেও দর্শক এই ছবি বড়পর্দায় দেখে এলে বুঝবেন, সত্যিই বাপ এসেছে।