‘কত কবি মরে গেল চুপি-চুপি, একা-একা’

ছবি: তাহাদের কথা

পরিচালনা: সুব্রত ঘোষ

অভিনয়ে: ঋষভ বসু, তৃষা দাস, রাজনন্দিনী পাল, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, দীপক হালদার, অমিত সাহা, বিশ্বনাথ বসু, কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজী, সৌরভ দাস, অরিন্দল বাগচি, ভদ্রা বসু

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট 

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

পাঠকের হাতে নির্ভর করে চরিত্রের আয়ু। যে বই পাঠক ভালোবেসে কাছে টেনে নেয়, নিজে পড়ে, উপহার দেয়, লাইব্রেরিতে রাখে, সে বইয়ের চরিত্রেরা যুগ-যুগ ধরে বেঁচে থাকে। যেমন করে আজও বেঁচে আছে অনিমেষ, মাধবীলতা, অমিত বা লাবণ্য। শতাব্দী পেরিয়েও যেভাবে বেঁচে আছে রহমত বা গফুর। জনপ্রিয়তা বাঁচিয়ে রেখেছে ব্যোমকেশ বক্সি, প্রদোষ মিত্র কিংবা রাজা রায়চৌধুরীকে। তবু একইসঙ্গে কত অজস্র নাম হারিয়ে গেছে, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে তার খবর কি কেউ রাখে? প্রতি বছর এমন কত চরিত্র তৈরি হয় এবং আরও হাজার খানেক বইয়ের ভিড়ে লড়াই করতে-করতে একদিন হয়তো শেষ হয়ে যায় চোখের আড়ালে। এই সমস্ত অজানা চরিত্রদের নিয়ে গল্প বুনে চলে সুব্রতর ছবি ‘তাহাদের কথা’ (Tahader Katha)। 



বইপাড়ার লেখকদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে চায় মানিক (সৌরভ)। না, কোনও নামকরা বেস্টসেলার লেখককে নিয়ে নয়। যার বই কেউ কেনে না, যাকে কেউ চেনে না, সেরকম কোনও অনামী লেখককে নিয়ে। কলেজ স্ট্রিটের দোকান ঘুরে সে খোঁজ পায় শ্রীকান্ত সোমের (কৃষ্ণেন্দু)। বহু বছর আগে চারটে উপন্যাস লিখেছিল শ্রীকান্ত। সেসব বই আর নেই। শ্রীকান্তও নেই। তার একসময়ের প্রিয় বন্ধু লোকনাথ (বিশ্বনাথ) এখন প্রকাশক। তার কাছে গিয়ে মানিক জানতে পারে সুস্মিতার (রাজনন্দিনী) কথা, যে অনলকে (অনিন্দ্য) হারিয়ে ফেলেছিল নিজের দোষেই। জানতে পারে রফিকুল (ঋষভ) আর প্রিয়াঙ্কার (তৃষা) অসমাপ্ত ভালোবাসার কথা। দেখা হয়ে যায় বড়বাজারের ঠেলাওয়ালা বুড়োর (দীপক) সঙ্গে। প্রাণহীন এই শহরের ইটের পাঁজরে যার ব্যর্থতার কাহিনি ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। আবার দেবরঞ্জনের (অমিত) পরিণতি আতঙ্কিত করে তোলে এই ভেবে যে লেখকের হাতে চরিত্র কি তবে খেলার পুতুল? তার জন্য সত্যিই কি কোনও মায়ামমতা কাজ করে না? 

আরও পড়ুন: বাংলাদেশি থ্রিলারে স্বস্তিকা

হারিয়ে যাওয়া লেখকের কাহিনির চরিত্রেরা এই ছবিতে রক্তমাংসের মানুষ হয়ে ওঠে। ভাবতে বাধ্য করায় সেই লেখকের কথা যার বহু পরিশ্রমের ফসল কোনও গল্প বা উপন্যাস পাঠক মহলে আদর পায় না, বা হয়তো সে খবরই পৌঁছয় না তাদের কাছে। প্রতিবছর কলেজ স্ট্রিটের সারি-সারি দোকানে এমন কত শত লেখকের জন্ম হয়। জন্ম মুহূর্তে যদি বা একটু হাসি, দুটো হাততালি, কিছু মিষ্টিমুখ থাকে, মৃত্যু হয় সকলের অজান্তেই। তবু লেখক হতাশ হয় না, সৃষ্টির এমনই মাহাত্ম্য।

Tahader Katha

এই ব্যর্থ চরিত্রদের প্রতি সহানুভূতি গড়ে তুলতে সফল সুব্রত। ছবির মাঝামাঝি অংশে একটা সময় ক্রমশ গুলিয়ে যেতে থাকে কোন চরিত্র আসল, কোনটাই বা কাল্পনিক। কারণ শ্রীকান্তর লেখা সব চরিত্রই খুব বাস্তব। তারা লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে উঠে নায়ক-নায়িকা হয় না ঠিকই, কিন্তু তাদের হতাশা, যন্ত্রণা, অনুতাপ ছুঁয়ে যায় দর্শককে। প্রথম দৃশ্যের চুম্বকই যেন উঠে আসে লোকনাথের কথায়, মানুষ আর বই পড়ে না। তাই বইয়ের চরিত্রেরাও ধীরে-ধীরে হারিয়ে যায়। বস্তুত এই বিশ্বব্যাপী অডিয়ো-ভিজ়্যুয়ালের  দাদাগিরি সামলে বই পড়ার অভ্যাস ক্রমশ পিছনের সারিতে গিয়ে পৌঁছেছে। দিন-দিন প্রখর হয়ে উঠছে বইয়ের অস্তিত্বের সংকট। আরও কিছু বছর পর হয়তো বা বইপাড়ার চেহারা বদলে গিয়ে সেখানে শুধু পাওয়া যাবে ই-বুক। তবু তাতে করেও নতুন প্রজন্মকে আটকে রাখা যাবে কি? নাকি বয়সের ভারে ধুঁকতে-ধুঁকতে প্রাচীন পাঠকের মৃত্যু হবে একদিন সমস্ত বইয়ের স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে! এত প্রশ্নের মাঝেও ছবির শেষটুকু আশা জাগিয়ে যায়। তবে সে আশা মরীচিকা কিনা সে কথা সময় বলবে। 

আরও পড়ুন: থাকছেন না সলমন?

তেমন কোনও তারকা শিল্পী ছাড়াই মনে ছাপ রেখে যায় ‘তাহাদের কথা’। ঋষভ, তৃষা, রাজনন্দিনী, অনিন্দ্য, সৌরভ প্রত্যেকেই এ ছবির সম্পদ। আলাদা করে মনে দাগ কেটে যায় কৃষ্ণেন্দু, দীপক ও অমিতের চরিত্রায়ন। তবে এ ছবির মূল চরিত্র নিঃসন্দেহে সোমক ভট্টাচার্য, বোধিসত্ত্ব মজুমদার ও শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি ও চিত্রনাট্য। তেমন কোনও বাঁধা গল্প ছাড়াই পৌনে দু’ঘণ্টা দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ছবির দৃশ্যপট। সঙ্গে আগাগোড়া যোগ্য সঙ্গত করে যায় অলক মাইতির মানানসই চিত্রগ্রহণ এবং মলয় লাহার সম্পাদনা। সপ্তক সানাই দাসের সুরে শ্রেয়া ঘোষাল ও কিঞ্জল চট্টোপাধ্যায়ের গানটি শুনতে ভালো লাগে। 

বাংলা বইয়ের সঙ্গে বাংলা ছবির অবস্থা নিয়েও ইদানিংকালে যে ধরনের হতাশাজনক কথাবার্তা উঠে আসে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুটা আশার আলো দেখাবে সুব্রতর ছবি। ছায়াছবির সমুদ্রে ক্রমশ ডুবতে থাকা মেধার ফাঁকে দর্শককে লাইটহাউস দেখাতে পারে ‘তাহাদের কথা’।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *