বিষয় হিসেবে ব্যতিক্রমী ও প্রশংসনীয়

ছবি: ইস্কাবন

পরিচালনা: মনদীপ সাহা

অভিনয়ে: সৌরভ দাস, সঞ্জু, অনামিকা চক্রবর্তী, খরাজ মুখোপাধ্যায়, দুলাল লাহিড়ী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়, সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়, অসীম রায়চৌধুরী, পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

ষাট-সত্তরের দশকে যে অতিবাম আন্দোলনে বাংলার রাজনীতি কেঁপে উঠেছিল তারই প্রতিফলন স্বরূপ পরবর্তীকালে লালগড় এলাকায় গড়ে ওঠে মাওবাদী কার্যকলাপ। এলাকায় মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দেওয়া অনেকেই ধীরে-ধীরে মাও সে তুংয়ের ভাবধারাকে আদর্শ করে গড়ে ওঠা বাহিনীতে যোগ দিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের পথে নাম লেখায়। তবে দুই ক্ষেত্রে ভাবধারা এক থাকলেও তা একইভাবে কার্যকর হয়েছিল কি? প্রশ্ন থেকেই যায়। 



২০০০ সালের পরবর্তী মাওবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৈরি ‘ইস্কাবন’ ছবির মূল নায়ক সত্য (সৌরভ) সশস্ত্র মাওবাদী বিপ্লবী। নরেনজীর (বুদ্ধদেব) নেতৃত্বে দল চললেও সত্যকে ডুংরির স্থানীয় আন্দোলনের নেতা বলা যায়। তার সোজা হিসেব, দলের নিয়ম মানতে না পারলে একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবু সবসময় তো সাদাকালো দিয়ে মানুষকে বিচার করা যায় না। নরেনজী বার বার বলেন লড়াইয়ের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই লড়াই। সত্য বোঝে না, বুঝতে চায় না। তার গরম রক্ত রাতারাতি সব বদলে দিতে চায়।

এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা সন্টু সোরেন (খরাজ) এলাকার উন্নয়নের টাকা ব্যক্তিগত কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন জনগণকে ঠকিয়ে চলে। নরেনজী সব বুঝলেও সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। নিজেদের জমি নিজেদের জঙ্গল তারা ছাড়বেন না, এই হলো একমাত্র যুক্তি। এ সবের মধ্যেও দলের সদস্য গোলাপীর (অনামিকা) প্রতি সত্যর দুর্বলতা দিন দিন বেড়ে চলে, যদিও সে বলতে পারে না কিছুই। ওদিকে ট্যুরিস্ট সেজে গ্রামে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান শিব মাত্র কয়েদিনের চেষ্টায় গোলাপীর মন জয় করে নেয়। সশস্ত্র বিপ্লবের নিষ্ঠুর রূপ দেখতে-দেখতে গোলাপী ততদিনে বীতশ্রদ্ধ। একদিন ঘটনাচক্রে পড়ে দুজনে পালাতে বাধ্য হয়। একদিকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের দল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া অন্যদিকে সন্টুর কারসাজি, সব মিলিয়ে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিপ্লবী বাহিনী।

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

ছবির বিষয় নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ও প্রশংসনীয়। তবে জমি রক্ষা ছাড়া বিপ্লবী বাহিনীকে আর কিছু করতে দেখা গেল না। তাদের রসদ কীভাবে আসছে সেটাও বোঝা গেল না। ‘ইস্কাবন’-এর মেজাজ অনেকটা নব্বইয়ের দশকের ছবির মতো। শিব ও গোলাপীর মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক আরও একটু সময়ের দাবি রাখে। একজন সশস্ত্র বিপ্লবী এভাবে রাতারাতি আদর্শ বদলে গৃহবধূ হয়ে যেতে পারে না। খুব অল্প পড়াশোনা করা গোলাপী হঠাৎ কী করে এমন শিক্ষিতা চাকুরে হয়ে ওঠে সে গল্পও না বলাই থেকে যায়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবীদের সংঘাতের দৃশ্য বেশ বাস্তবিক লেগেছে। গুলিগোলা, বোমা, মাইন বিস্ফোরণ হোক বা অপশব্দ উচ্চারণ, কার্পণ্য করেনি ‘ইস্কাবন’। ফলে গোটা ছবির মধ্যে রুক্ষ শুষ্ক মাটির গন্ধ থেকে গিয়েছে, যা ছবির কাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।



ছবির ক্লাইম্যাক্স বেশ ভালো, ক্রমশ ভাঙতে-ভাঙতে সত্যর জ্বলে ওঠা বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি রেখে যায়।

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়ের সুরে ছবির সবক’টি গানই শ্রুতিমধুর। নচিকেতা চক্রবর্তীর গাওয়া ‘ইস্কাবনের বিবি’ গানটির সঙ্গে খুব জনপ্রিয় একটি হিন্দি গানের সুরের কিছু মিল থাকলেও সেটি আলাদাভাবে সুন্দর। রূপঙ্কর বাগচী ও অন্বেষা দত্তগুপ্তর গাওয়া ‘জোনাকি’ গানটি গতে বাঁধা গানের চেয়ে অন্যরকম এবং বেশ মিষ্টি। শানের গাওয়া ‘হারিয়েছ মন’ গোলাপীর ব্যথাকে দর্শকের মনে সঞ্চার করতে সফল। অনিন্দ্যর কাছে ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজের আশা রইল। এর সঙ্গে আলাদা করে অবশ্যই উল্লেখ্য, খরাজের গলায় টুকরো-টুকরো অজস্র গান দর্শকদের তৃপ্ত করেছে প্রতিটি দৃশ্যে।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

সঞ্জু এবং অনামিকা ছাড়া প্রায় প্রত্যেকেই পোড় খাওয়া অভিনেতা হওয়ায় প্রত্যাশা ছিলই। তবু নতুন হয়েও অবাক করলেন সঞ্জু ও অনামিকা। ছোট চরিত্রেও সঞ্জু দেখিয়ে দিলেন তথাকথিত শহুরে ঝকঝকে চেহারা ছাড়াও দর্শকের মনে ছাপ রাখা যায়।

গোলাপীর ভূমিকায় অনামিকা অনবদ্য। এমনকি তিনি ছাড়া এত রুক্ষতার সঙ্গে মায়া মিশিয়ে গোলাপীকে যথাযথ রূপ দেওয়া হয়তো আর কারও পক্ষে সম্ভব হতো না। সৌরভ বরাবরের মতই নিজের চরিত্রে উজ্জ্বল ও দুর্দান্ত। এই ধরনের চরিত্রে তিনি কতটা উপযুক্ত তা সৌরভ আগেও প্রমাণ করেছেন। খলচরিত্রে খরাজ অসম্ভব ভালো। নরেনজীর চরিত্রে বুদ্ধদেবও যথাযথ। ভালো লাগে বিপ্লবী দলের অন্য সদস্যদেরও। ভালো লেগেছে প্রথম দৃশ্যের ডুমন চরিত্রের অভিনেতাকেও।

আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি

অনেকদিন পর সুমিতকে ছোট একটি চরিত্রে দেখা গেল। একসময় বহু বাংলা ছবিতে খলচরিত্রে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন তিনি। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর অফিসারের চরিত্রে আরও সুঠাম চেহারার প্রয়োজন ছিল। অরিন্দমের মতো অভিজ্ঞ অভিনেতার বাংলা ছবিতে আরও বেশি কাজ করা উচিত ছিল। এখানে ছোট চরিত্রে মানিয়ে গিয়েছেন তিনি।

জমি অধিগ্রহণ আটকাতে সশস্ত্র বিল্পব ও নির্বিচারে খুন নাকি আপোষের রাস্তা? মানবকল্যাণে ও আদিবাসীদের স্বার্থে আসলে কোন পথ বেশি কার্যকরী তা নিয়ে দিনের শেষে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবু কেউ জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে চাইলে তার জন্য সব রাস্তা খোলা থাকা উচিত। সমাজের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য সমাজ, শিবের মুখে এই বার্তা নিশ্চিন্ত করে অনেকটা। মনুষ্যত্ব এখনও কিছুটা হলেও বেঁচে আছে তাহলে। শুধু মনখারাপ করে দেয় ছবির শেষ দৃশ্য যেখানে দোকানঘরের দুই দরজায় লেখা দুটি বাক্য একযোগে নতুন অর্থ তৈরি করে, ‘বিপ্লব বন্ধ আছে’। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
4

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *