সহজ, সরল, বইকেন্দ্রিক

সিরিজ়: ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি (দার্জিলিং জমজমাট)

পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, কল্পন মিত্র, বরুণ চন্দ, রাহুল বন্দোপাধ্যায়, সুপ্রভাত দাস, সাহেব ভট্টাচার্য, সুব্রত দত্ত, মৈনাক বন্দোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট (৬ পর্বে)

RBN রেটিং: ৩/৫

‘নয় অপেক্ষা নয় রে আর/বাধল কাণ্ড ধুন্ধুমার/ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি/জমবে এবার!’ জয় সরকারের সুরে জমাটি শীর্ষসঙ্গীতের হাত ধরে আবারও আটঘাট বেঁধে রহস্য অনুসন্ধানে নেমে পড়ল ফেলুদা, ওরফে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। এবারের গন্তব্য দার্জিলিং। তবে এ দার্জিলিং সেই আশির দশকের, যেখানে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে রাস্তায়-রাস্তায় পোস্টার সাঁটানো রয়েছে। সে সময় যদিও দার্জিলিংয়ের রাস্তাঘাট এত পরিষ্কার থাকত না, তবু বিরূপাক্ষ মজুমদারের পারিপার্শ্বিক অনেকটা তার মতোই ফিটফাট ও ঝকঝকে।



ফেলুদাদের দার্জিলিংয়ে আসার মূল কারণ ছিল লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর একটি উপন্যাস নিয়ে পরিচালক পুলক ঘোষালের ‘কারাকোরাম কে খিলাড়ি’ ছবির শ্যুটিং। সেই উপলক্ষেই ছবির অভিনেতাদের সঙ্গে ও পরে বিরূপাক্ষের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘটনাচক্রে একটি হত্যার তদন্তে ফেলু-তোপসে-জটায়ুর জড়িয়ে পড়া। গল্প যেহেতু প্রায় সকলেরই জানা তাই এর বেশি বলার প্রয়োজন নেই।

সিরিজ়ের লক্ষণীয় বেশ কিছু জিনিস একনজরে বলে নেওয়া যাক, যার মধ্যে ভালো মন্দ দুটোই আছে। 

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

আশির দশকের কাহিনীর ভূমিকা করতে পুলক ঘোষালের ছবির দৃশ্যের অবতারণা বেশ নাটকীয়। সেই ছবির কাহিনী জটায়ুর হলেও দৃশ্যটি বলা বাহুল্য তার গল্পে ছিল না। কিন্তু আশির দশকে বাজার চলতি হিন্দি ছবি করতে হলে নায়িকাকে বন্দী করে ভিলেনের গরম-গরম সংলাপ রাখতে পারলে ছবি হিট করা কেউ আটকাতে পারত না, তাই শুরুটা বেশ জমে যায়। ছিয়াশি সালের ঘটনা বলেই পুলক ঘোষালের মুখে মারাদোনার হ্যান্ড অফ গডের উল্লেখ শুনতে বেশ মজাদার লাগে। তবে মূল কাহিনীর ‘এভারেস্ট’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামের হোটেল পাল্টে উইন্ডারমেয়ার করার কারণ বোঝা গেল না। সে যুগেও দার্জিলিংয়ের অন্যতম বিলাসবহুল হোটেল হিসেবে পরিচিত ছিল উইন্ডারমেয়ার। সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির শ্যুটিং হয়েছিল সেখানে। সেই কথা মাথায় রেখেই হয়তো উইন্ডারমেয়ারকে ছবিতে রাখলেন সৃজিত।

নয়নপুর ভিলায় পৌঁছে বিরূপাক্ষের ঘরে গিয়ে বসা কিছুটা ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’কে মনে পড়ায়। যদিও এক্ষেত্রে পরিচালকের বিশেষ কিছু করার নেই। মূল গল্প অনুযায়ী অ্যান্টিডিপ্রেশন পিল হিসেবে টফ্রানিল যথেষ্ট পরিচিত নাম, বইতেও সেই নামই ব্যবহৃত হয়েছে। সিরিজ়ে সেই ওষুধের নাম ট্রফানিল হয়ে গেল এবং একাধিকবার ওই নামই উচ্চারিত হলো। আসল ওষুধের নাম নিলে আইনগত সমস্যা হতে পারত কি? জানা নেই।

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

আর ফেলুদা হয়তো সবই জানে, তাই বলে মহিলাদের বিদেশি পারফিউম সম্পর্কেও তার এত স্পষ্ট ধারণা দেখে কিছুটা কৌতুকের উদ্রেক হয় বইকি!

লালমোহনবাবুর অতীতের নানা কীর্তি বোঝাতে ফ্ল্যাশব্যাকের ব্যবহার দেখতে বেশ ভালো লাগে। আবার অঘোরচাঁদ বাটলিওয়ালার চরিত্রে অনির্বাণ যেন একেবারে বই থেকে উঠে আসা জটায়ু। আর একটি দৃশ্যের কথা বলতেই হয়। চিড়িয়াখানায় গিয়ে ফেলুদার স্নো লেপার্ডের চোখে চোখ রাখার দৃশ্য। গল্পের ক্ষেত্রে না হলেও সিরিজ়ে সুন্দর সংযোজন।

আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি

তবে এই সবকিছুর মধ্যে বারংবার দেখার পরেও যে দৃশ্য নিয়ে খটকা রয়ে যায় তা হলো ছুরি মারার শারীরিক অবস্থান। লক্ষ্যের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আক্রমণকারী ওই জায়গা থেকে কখনওই সর্বশক্তি দিয়ে একজন লম্বা মানুষের বুকের উচ্চতায় একবারের চেষ্টায় ক্ষত করতে পারে না। এক যদি না সে পেশাদার খুনি হয়। এক্ষেত্রে তেমন কেউ ছিল না।

এছাড়া পাংখাবাড়ির রাস্তায় সমীরণকে ধরার জন্য গাড়ি নিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলার দৃশ্য দেখতে দারুণ লাগে। সৃজিতীয় ড্রোন শটে সাংঘাতিক প্যাঁচালো রাস্তা আর হেয়ারপিন বেন্ডকে দেখানো হয়েছে নাটকীয়ভাবে। তবে গুলি করার প্রয়োজন ছিল না বোধহয়। আবার পুলিশ থাকতেও ফেলুদা কেন গুলি করল সেটা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। একই সঙ্গে সমীরণকে দেখতে পেয়ে একা ফেলুদার নেমে যাওয়া ও ফিরে আসা এবং গাড়িতে পুলিশ ইন্সপেক্টরের স্থাণুবৎ বসে থাকা বেশ চোখে লাগে।

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

অভিনয়ের দিক দিয়ে প্রথমেই বলা যায় বিরূপাক্ষরূপী বরুণের কথা। খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে চরিত্রটিকে তুলে ধরেছেন তিনি। টোটাকে এই সিরিজ়ে আগের চেয়ে সাবলীল লেগেছে। তবে ফেলুদা আরও একটু হাসতেই পারে। এমন রামগরুড়ের সন্তানসম গাম্ভীর্য ফেলুদার ছিল না বোধহয়। কল্পন আগের মতোই ভালো তবে তোপসে কিছুটা প্রাণবন্ত হলে মন্দ হতো না। অনির্বাণ এখানে আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ ও জটায়ুচিত। তাঁর নানা মৌখিক অভিব্যক্তি দেখতে ভালো লেগেছে। সম্ভবত রাহুলকে এই প্রথমবার একেবারে অন্যরকম একটি চরিত্রে দেখা গেল। নিজের চরিত্রে যথাযথ তিনি। সাহেব আরও উজ্জ্বল হতে পারতেন। সুব্রতর মতো সুঅভিনেতার এখানে তেমন কিছু করার ছিল না। মৈনাকের কাছে আরও বেশি আশা ছিল। 

সিরিজ় শুরুর সময় টাইটেল কার্ডে ফেলুদার ইলাস্ট্রেশন ও শিলাজিৎ, সিদ্ধার্থ রায় (সিধু) ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের গলায় সমবেত গান এক আলাদা আবহ তৈরি করে দেয়। ফেলুদা দেখতে বসে যে অ্যাডভেঞ্চারের অপেক্ষা আট থেকে আশি সকলেরই মনে কিঞ্চিৎ থেকে যায় তাকে সাফল্যের সঙ্গে পূরণ করেছেন জয়। পরিচালককে ধন্যবাদ আবারও এক সহজ, সরল, সংলাপের জটিল মারপ্যাঁচবিহীন, বইকেন্দ্রিক সিরিজ় উপহার দেবার জন্য। আগামীতে আরও ফেলু কাহিনীর অপেক্ষা রইল। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *