“এখন পরিচালক, চিত্রনাট্যকাররা আমার জন্য চরিত্র তৈরি করছেন”

‘গোলন্দাজ’ ছবির ট্রেলারের শুরুতেই যে সাহেব ফুটবলকে তাদের নিজেদের খেলা বলে অভিহিত করেছেন, সেই অ্যালেক্স ও’নেল এখন অনেকেরই চেনা। ‘ইয়েতি অভিযান’-এর কেন শিপটন থেকে ‘গোলন্দাজ’-এর মেজর ফ্রেডরিক জ্যাকসন, শুধু বাংলাই নয়, হিন্দিতেও নানা ছবি ও ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করেছেন এই মার্কিন অভিনেতা। ভারতকে নিজের পেশার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া অ্যালেক্স জানালেন তাঁর এই সফরের কথা। শুনল রেডিওবাংলানেট

মার্কিন নাগরিক হয়েও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ছবিতে তুমি এখন কাজ করছ। হিন্দি ছাড়াও তামিল ও বাংলা ছবিতে বড় চরিত্রে তোমাকে দেখা যাচ্ছে। ভারতের বিনোদন জগৎকে বেছে নেওয়ার কারণ কী?

আমি ভারতকে বাছিনি, ভারত আমাকে বেছেছে। বা বলা ভালো আমরা একে অন্যকে বেছেছি। ছ’-সাত বছর বয়স থেকে আমি অভিনয় করি। থিয়েটার করতাম, গিটার বাজাতে শিখেছিলাম, গানও করেছি। বছর কুড়ি বয়স পেরোতে না পেরোতেই আমি পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। ভারতে কাজ করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। আমি যখন মুম্বইতে ছিলাম, তখন আমার এক বন্ধু এখানকার বিনোদনের জগতে কাজ করত। তার মাধ্যমেই আমি প্রথমে মডেলিং দিয়ে কাজ শুরু করি। তারপর বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে কাজ করতে-করতে ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাই। ছবির নাম ছিল ‘চিনি কম’। তারপর অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি। এরপর ‘ইয়েতি অভিযান’ ছবিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করি। তারপর থেকে তো চলছেই। বেশ কিছু টেলিভিশন শোতেও কাজ করেছি। একটা বেশ নতুন রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি ক্রমে ভরে উঠছে।




ভারতীয় ছবিতে কাজ করার আগে কি এ দেশের ছবি দেখতে?

সত্যি কথা বলতে কী, না। ভারতীয় ছবিতে কাজ করার সূত্রেই এখানকার চলচ্চিত্র জগৎকে জেনেছি, চিনেছি। আমি যখন ইউরোপ বা আমেরিকায় থাকতাম, তখন সেখানে ভারতীয় ছবি খুব একটা দেখানোও হতো না।

এখনও কী পরিস্থিতি একই রকম?

না, এখন দ্রুত বদল ঘটছে। এই সপ্তাহেই ‘গোলন্দাজ’ কানাডা, আমেরিকাসহ সারা ভারতে মুক্তি পেল। ভাবতেও ভালো লাগছে, ভারতীয় সিনেমা ধীরে হলেও আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে সুস্মিতা সেনের সঙ্গে ‘আরিয়া’ ওয়েব সিরিজ়ে কাজ করলাম। সেটা বিশ্বের দর্শকের কাছে পৌঁছেছে। ওয়েব মাধ্যমের (ওটিটি) দৌলতে অনেক ভালো মানের কাজ বিশ্বের দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। এটা উন্নতি তো বটেই! ভারতের বাইরে আমার যে সব বন্ধুরা আছে, তারা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে, কীভাবে আমার ছবি দেখতে পাবে। ওটিটির দৌলতে তাঁদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে।

আরও পড়ুন: যন্তর মন্তর কক্ষের নেপথ্যে

এখানে কাজ করার সূত্রে কার-কার ভক্ত হয়ে উঠলে? নামগুলো একটু শোনা যাক

(হাসি) কারোর নাম বাদ দিলে মুশকিল হবে। এখনও পর্যন্ত অমিতাভ বচ্চন, রাজকুমার রাও, মনোজ বাজপেয়ি, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি ও আরও অনেকের সঙ্গে অভিনয় করেছি। তালিকা শেষ হবে না। বাংলায় প্রসেনজিৎ, দেবের সঙ্গেও কাজ করেছি। এঁরা প্রত্যেকেই অসাধারণ। তবে দেবের কথা আলাদা করে বলা উচিত। ছেলেটি অত্যন্ত পরিশ্রমী, অসম্ভব গুণী। ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় (‘গোলন্দাজ’ পরিচালক) দেবের এই প্রতিভাকে অসম্ভব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এদের সবার সঙ্গে যত কাজ করেছি, তত আমার নিজের অভিনয় ক্ষমতারও উন্নতি হয়েছে।

অমিতাভ, নওয়াজ়, রাজকুমার, মনোজ থেকে শুরু করে প্রসেনজিৎ, দেব, আজ়মেরি হক বাঁধন, এরা প্রত্যেকেই তারকা। এঁদের সঙ্গে কাজ করতে কোনওরকম অসুবিধায় পড়তে হয়নি?

একদমই না। একটা উদাহরণ দিই। ‘চিনি কম’-এ আমার বেশিরভাগ দৃশ্যই অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ছিল। সেই সব দৃশ্যে, যেখানে ক্যামেরার ফোকাস আমার উপর, সেখানে উনি চাইলেই অন্য কাউকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে, উনি নিজে দাঁড়িয়ে অভিনয় করেন। ওঁর উপস্থিতিতেই যেন আমার অভিনয়ের ক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এছাড়া তুমি যাদের কথা বললে, তাঁরা প্রত্যেকেই অসামান্য শিল্পী। প্রত্যেকেই সাংঘাতিক পেশাদার। এই পেশাদারিত্বের জন্যই আজ তাঁরা এতটা সফল। এরা সকলেই আমার অভিনয় ক্ষমতা নানাভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে আমি যেহেতু ভারতে জন্মাইনি এবং ভারতীয় সিনেমা সম্পর্কে খুব একটা ধারণাও ছিল না, তাই এই সব শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার সময় হতভম্ভ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আমি সাবলীলভাবে নিজের সেরাটুকু দিয়ে কাজ করেছি।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

‘গোলন্দাজ’-এ অভিনয় করার আগে কি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে জানতে? মেজর জ্যাকসনের ভূমিকায় অভিনয়ের আগে কী ভেবেছিলে?

আমি তো আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম! আমি ছেলেবেলা থেকেই ফুটবল খেলছি। ফুটবল নিয়ে এমন একটা ছবি হচ্ছে, তাতে আমিও কাজ করব, আনন্দ তো হবেই! এর আগে ক্রিকেট নিয়ে ‘ইনসাইড-এজ’ ছবিতে করলেও ফুটবল নিয়ে কখনও করিনি। তবে এ তো শুধু ফুটবল নয়, এ এক সংগ্রামের কথা। নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর মতো মানুষকে সারা বিশ্বের জানা উচিত। যে মানুষটা শুধু স্লোগান দিয়ে বিপ্লব ঘোষণা করেনি, বোম ফাটায়নি, বরং ব্রিটিশদের সঙ্গে মাঠে নেমে চোখে চোখ মিলিয়ে লড়াই করেছে। আগুন নগেন্দ্রও জ্বালিয়েছিল। তবে তা মাঠে, পায়ে ফুটবল নিয়ে। তার প্রভাব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও পড়েছে। এর আগে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন ছবিতে কাজ করেছি। ‘বোস: ডেড অর অ্যালাইভ’, ‘চিটাগং’-এর মতো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলাম। তখনই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ব্যাপারে অনেক কিছু জেনেছিলাম। এই ছবিতে কাজ করার সূত্রেই নগেন্দ্রপ্রসাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। সেই সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খেলাও যে কীভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, তা উপলব্ধি করেছি।

ভারতীয় দেশাত্মবোধক ছবি তো অনেকগুলো করলে। এর মধ্যে কোনটা সবথেকে কঠিন বলে মনে হয়েছে?

পরিশ্রমের দিক দিয়ে দেখতে গেলে অবশ্যই ‘গোলন্দাজ’। মাঠে নেমে একটা কী দুটো ফুটবল ম্যাচ খেলা আর সেই খেলাকে ফুটবলকে কেন্দ্র করে একটা ছবিতে কাজ করা আকাশ-পাতাল তফাৎ। ছবিতে কাজ করতে-করতে আমাদের দলের অনেকেই আহত হয়। প্রায় আট মাস কাজ বন্ধ ছিল। তারপর আবার নতুন করে শ্যুটিং শুরু হয় । এছাড়া ‘২১ সরফরোশ সরগরহি’ও খুব কঠিন কাজ ছিল। এখানে আমাকে পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলতে হয়েছিল। ভাস্কো দা গামা আর ক্যাপ্টেন উইনস্টন, দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছিল। এই সব চরিত্র ঐতিহাসিক। এদের নতুন করে তুলে ধরা খুব কঠিন। আর বাস্তব চরিত্রকে পর্দায় তুলে ধরা শতগুণে কঠিন। তাঁদের আচার-আচরণ, হাবভাব সব বুঝে তারপর তা অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হয়। ‘গোলন্দাজ-এ আমার চরিত্রটা জন জ্যাকসনের আদলে তৈরি। তার ব্যাপারে সামান্য যেটুকু জানা যায়, সেটা জানার পরেও মনে অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল। সেগুলোর উত্তর নিজেকেই আন্দাজ করে নিয়ে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে।

আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান

সৃজিত মুখোপাধ্যায় ও ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়, কার সঙ্গে কাজ করে বেশি আনন্দ পেলে?

দেখো, দুজনেই তাঁদের মতো করে সেরা। সৃজিতের সঙ্গে তিনটে কাজ হয়ে গেল। ওর সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। তবে সৃজিত আর ধ্রুব, দুজনেরই চিত্রগ্রহক সৌমিক (হালদার)। তাই কাজের মধ্যে কিছুটা মিলও রয়েছে। ওদের সঙ্গে আরও কাজের ইচ্ছে রয়েছে। তার সঙ্গে আরও নতুন পরিচালকের সঙ্গে তো বটেই। ধ্রুবর সঙ্গে একটা ওয়েব সিরিজ় নিয়ে কথাও হয়েছে। ওর সঙ্গে কাজ তো সবে শুরু। ধ্রুব খুবই প্রতিশ্রুতিমান, পরিশ্রমী পরিচালক। ও অনেক দূর যাবে।

বইয়ের পাতা থেকে হোক, বা আগে হওয়া কোনো ছবি থেকে, কোন চরিত্রে অভিনয় করার স্বপ্ন দেখো?

‘আরিয়া’ সিরিজ়ে আমি বব নামে এক মিউজ়িশিয়নের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। গান আমার অত্যন্ত ভালোবাসার জায়গা। অন্যদিকে অভিনয় আমার পেশা। ববের চরিত্রে ভালোবাসা আর পেশা মিশে গিয়েছিল । এমনকি এই চরিত্রে অভিনয়ের ফল হলো আমার ইউটিউব চ্যানেলের দ্বিতীয় গান ‘ভগবৎগীতা সং’। ধ্রুবর ছবিতেও আমার ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা আর কর্মক্ষেত্র মিশে গিয়েছে। তবে ববের মতো কোনো চরিত্র যদি পাই, যেখানে গান গাওয়ার সুযোগ আছে, সেখানে আমি এক পায়ে খাড়া। আমার খুব পছন্দের দুটো ছবি ‘রকস্টার’ আর ‘আশিকি ২’। গানের মাধ্যমেই গল্প এগোয় এই ছবিগুলোতে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ‘লা লা ল্যান্ড’ ছবিতে। এই ধরণের কাজ পেতে মুখিয়ে রয়েছি। এখন দেখছি পরিচালক, চিত্রনাট্যকাররা আমার জন্য চরিত্র তৈরি করছেন।



আগামী দিনে যদি হলিউডে ডাক পান, তাহলে কী করবে?

ভারতেও কাজ করব, ওখানেও। তবে শুধু হলিউড নয়, আমাকে কেপটাউন, আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ডসেও যেতে হয়। অভিনয়ের পাশাপাশি আমি গানের চর্চাটাও ধরে রেখেছি। আর যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় পৃথিবীটা তো খুব ছোট হয়ে গিয়েছে। কাজেই, অসুবিধে হবে না।

এখন কী-কী কাজ চলছে?

আপাতত একটা ওয়েব সিরিজ়ে জন্য তামিলনাড়ুতে শ্যুটিং করে এলাম। এখানকার অভিনেতা থেকে শুরু করে পরিচালক, সকলেই আমার কাছে নতুন। কিন্তু দারুণ আনন্দ পেয়েছি কাজটা করে। এছাড়া তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায় ও আসিফ বাসরার সঙ্গে ‘রানী রানী রানী’-তে কাজ করেছি। এটা হিন্দি আর ইংরেজি ভাষায় বেরোনোর কথা। এছাড়া ডিসেম্বরে একটা সিরিজ় আসছে সেখানে আমাকে হিন্দিতে সংলাপ বলতে হয়েছে। অর্জুন রামপালের সঙ্গে ‘ব্যাটল অফ ভীমাকোরগাঁও’ ছবিতে কাজ করছি। আমার নতুন গান ‘ফায়ার অ্যাওয়ে’ আসছে। গানটা মূলত রক সং। এটাও শীঘ্রই মুক্তি পাবে।



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *