তিলক কামোদ, ভৈরবীতে অপুকে ফেরালেন বিক্রম
কলকাতা: মঞ্চে উপস্থিত প্রয়াত কিংবদন্তি গুরুর সুযোগ্য শিষ্য। তাঁর দুপাশে সঙ্গত করতে হাজির সমসাময়িক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তরুণ তুর্কির দল। গুরুর সৃষ্ট সুরের ছোঁয়া রেখে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবে তাঁর শাগরেদ। ঘোষিকার ভূমিকা শেষ হতেই কমে গেল আলো, শুরু হলো সঙ্গীতের মূর্ছনা। ‘তিলক কামোদ’ রাগে গ্রাম বাংলার মাটির সুরের আদল দিয়ে শিষ্য কখন জানি গুরুর চরণ স্পর্শ করে গেলেন। এক অনবদ্য সুর সন্ধ্যায় একের পর এক তারের ঝঙ্কারে কখনও বাজল ‘যোগ’, তো কখনও ‘ভৈরবী’। সাতসুরের জাল বুনে গতকাল সন্ধ্যায় শ্রোতাদের এক অনন্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি যিনি দাঁড় করালেন, তিনি বিক্রম ঘোষ। সুর-তাল-লয়ের অভিঘাতে তিনি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানালেন গুরু রবিশঙ্করকে। যোগ্য সঙ্গত করলেন সেতারে অভিষেক মল্লিক, সরোদে প্রতীক শ্রীবাস্তব, বাঁশিতে সৌম্যজ্যোতি ঘোষ ও কিবোর্ডে সায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, সঙ্গে তবলায় বিক্রম নিজে।
তবে শুধুই শ্রদ্ধা জানানো নয়, গতকাল হয়ে গেল পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রর ছবি ‘অভিযাত্রিক’-এর আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত প্রকাশ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘অপরাজিত’র শেষাংশ নিয়ে তৈরি এই ছবিতে অভিনয় করেছেন অর্জুন চক্রবর্তী, দিতিপ্রিয়া রায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, বরুণ চন্দ, বিশ্বনাথ বসু ও সোহাগ সেন। সেই সূত্রেই ‘পথের পাঁচালি’র সুরকারকে তাঁর কাজের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানালেন ‘অভিযাত্রিক’-এর সঙ্গীত পরিচালক বিক্রম। গত এক বছরে দেশ-বিদেশের নানা ফিল্ম উৎসবে পুরষ্কৃত ও সম্মানিত হয়ে অবশেষে ছবিটি মুক্তির দোরগোড়ায়। গতকাল অনুষ্ঠানে পরিচালক ও শিল্পীরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ছবির উপস্থাপক মধুর ভান্ডারকর ও গৌরাঙ্গ জালান।
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
অপু ট্রিলজির রেশ রেখে এই ছবি নির্মিত হলেও ‘অভিযাত্রিক’-এ সঙ্গীতের ব্যবহার অনেকটাই বেশি। সেটার কারণ হিসেবে শুভ্রজিৎ রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন, “আমার ইচ্ছে ছিল ছবিটা যেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটা জার্নি হিসেবে থেকে যায়। আজকাল বাংলা ছবিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা ফোকের ওপর কাজ খুব একটা হয় না। তাছাড়া ছবিটাকে তো আমি ট্রিলজির মতো করে বানাইনি বা তার সঙ্গে তুলনায় যাব না। এটা আমার আর বিক্রমদার চিন্তাভাবনা ছিল। আমাদের ইন্টারপ্রেটেশন বলা যায়। আর সেটা যে দর্শকদের ভালো লেগেছে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোই তার প্রমাণ। আশা করা যায় এখানেও ছবিটা সকলের ভালো লাগবে।”
এই ছবির সুরসৃষ্টি তাঁর সঙ্গীত জীবনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল বলে মনে করেন বিক্রম। “সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলোর প্রতিটা ফ্রেম এবং রবিশঙ্করজীর ‘পথের পাঁচালি’ থিম, এগুলো তো বাঙালির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে রয়েছে,” বললেন তিনি।
অপু ট্রিলজির সবকটা ছবি ও তার সুর, সবটাই ভীষণরকম আইকনিক এবং সেই কাজে হাত দেওয়াই একটা দুঃসাহসিক ব্যাপার বলে মনে করেন বিক্রম। “তবে শুভ্রজিৎ শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিল,” জানালেন তিনি। “এই কাজটা নিয়ে ও দশ বছর খেটেছে। এবার এল আমার পালা। আমি অপু ট্রিলজির স্পিরিটটা রাখতে চেয়েছি। প্রায় সবটাই ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করে সামান্য কিছু ফোকের ছোঁয়া রেখে কাজটা করেছি।”
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
দীর্ঘ বারো বছর রবিশঙ্করের সঙ্গে এক হাজারেরও বেশি কনসার্টে তাঁকে সঙ্গত করেছেন বিক্রম। প্রয়াত গুরুর কাজের ধরণ একেবারে পাশে বসে দেখেছেন তিনি। এগুলোই তাঁকে ‘অভিযাত্রিক’ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে রবিশঙ্করের স্ত্রী সুকন্যার থেকে পাওয়া প্রশংসাই তাঁর সবথেকে বড় প্রাপ্তি বলে জানালেন বিক্রম। “সুকন্যাজীকে আমরা চিনাম্মা বলি। চিনাম্মা মনে করেন আমি রবিশঙ্করজীর সুরকে আত্মস্থ করতে পেরেছি। এছাড়া অনুষ্কারও (শঙ্কর) ভরসা ছিল আমার ওপর। অনুষ্কার বারো বছর বয়স থেকে আমি ওর সঙ্গে বাজিয়েছি। তাই ও জানতো কাজটা আমি যত্ন নিয়েই করব,” বললেন বিক্রম।
করোনা অতিমারির কারণে গত বছর রবিশঙ্করের জন্মশতবর্ষ সেভাবে উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। তাই শতবর্ষে ‘অভিযাত্রিক’ গুরুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি বলে জানালেন বিক্রম।
৩ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে চলেছে ‘অভিযাত্রিক’।