মুশকিল আসানের সহজ সুরে রঙিন

ছবি: গুলদস্তা

পরিচালক: অর্জুন দত্ত

অভিনয়ে: স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, ঈশান মজুমদার, অনুভব কাঞ্জিলাল, অনুরাধা মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ গুহ, ছন্দা করঞ্জি চট্টোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৪ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

গৌতম বুদ্ধর সেই গল্পটা বোধহয় সবারই জানা। এক মা তার মৃত সন্তানের জীবন ভিক্ষা করতে গেলে গৌতম বুদ্ধ বলেন, সেই নগরীর এমন একটি বাড়ি থেকে একমুঠো সর্ষে তাঁকে এনে দিতে হবে যেখানে কোনও মৃত্যু হয়নি। আনতে পারেননি সেই মা। কারণ মৃত্যুহীন কোনও বাড়ি পাওয়া যায়নি। ঠিক সেভাবেই দুঃখ কষ্টহীন মানুষের জীবনও যেন সাজানো ইউটোপিয়াই। শুধু এই শহরের কেন, হয়তো সমস্ত পৃথিবী খুঁজে দেখলেও এমন কোনও বাড়ি, এমন কোনও সংসার খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে সমস্যা নেই, দুঃখ নেই। তাই দুঃখ, বেদনা, না পাওয়া এসব চিরন্তন সত্যের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। চেষ্টা করে খুঁজে নিতে হয় সমাধানের পথ। নিজে খুঁজে পেলে ভালো, নাহলে মুশকিল আসান হয়ে আসে ধনঞ্জয় কিংবা ডলিরা। 




শ্রীরূপা (অর্পিতা) আর রেণু (দেবযানী) প্রতিবেশী। বয়সের ফারাক থাকলেও একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই দুজনের সুখ দুঃখের খবর রাখে। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই শ্রীরূপা আর রেণুর জীবনেও আছে কিছু ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও না পাওয়ার গল্প। শ্রীরূপার স্বামী অর্ণব অন্য নারীতে আসক্ত। স্বামীর অবজ্ঞা ও সন্তানহীনতার একাকীত্ব মিলিয়ে শ্রীরূপা মানসিকভাবে খাদের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে, অর্ণবকে ভালোবাসলেও তাকে ফেরাবার শক্তিটুকুও তার নেই। অন্যদিকে স্বামী, সন্তান, শাশুড়িকে নিয়ে রেণুর ভরা সংসার। সুখ যেন তার চোখেমুখে উপচে পড়ে। কিন্তু প্রতিদিন একটু একটু করে ছেলে টুকাইয়ের (অনুভব) নষ্ট হয়ে যাওয়া, স্বামীর (অভিজিৎ) লম্বা-লম্বা ব্যবসায়িক ট্যুরে বাইরে থাকা ও নানা অসুস্থতায় ভোগা শাশুড়িকে (ছন্দা) নিয়ে আসলে সে বড়ই একা। তার নিজের দিকে দেখার সময় হয় না।

বাস্তবে এমনটা হামেশাই হয়ে থাকে। শ্রীরূপা ও রেণুর মতো হাজারো মেয়েদের নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়ে যেতে হয়। কিন্তু রুপোলি পর্দার কথা আলাদা। সেখানে সব সমস্যার সমাধান নিয়ে আসে ডলি বাগড়ি (স্বস্তিকা), তার সব পেয়েছির ঝোলায় পুরে। তার কাছে আছে সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির চাবিকাঠি। কে এই ডলি? কী তার পরিচয়? কীভাবে সে সকলের সমস্যা মেটাবে? এই সব জানতে গেলে ছবিটা হলে গিয়ে দেখতে হবে। 

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

‘গুলদস্তা’ দেখতে বসে তপন সিংহের ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’র ধনঞ্জয়ের কথা অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায়। সেখানে সেই ছিল সবার মুশকিল আসান। এখানে যেন খানিকটা তেমনভাবেই আসে ডলি। তফাৎ খালি সময়ের। ষাটের দশকে সাংসারিক সমস্যার সঙ্গে তো আর ২০২০ কে মেলানো যায় না। তাই সমস্যা আরও জটিল, যদিও তার সমাধান হয়েছে সহজভাবেই। দুটো ছবির মধ্যে তুলনা টানছি না, তবে বিষয়টা যেন অনেকটা একইরকম। যদিও ধনঞ্জয়ের অস্তিত্ব সেখানে ছিল রহস্যময়। এখানে ডলি অনেক বেশি বাস্তব। তার নিজেরও সংসার রয়েছে, আছে রূপ কেয়ারের মতো প্রসাধন কোম্পানীর চাকরি। সেই ডলির ছোঁয়ায় রেণু ও শ্রীরূপার সঙ্গে পরোক্ষে সমাধান হয়েছে রিয়ার (অনুরাধা) সমস্যাও।

কিন্তু সব একটু বেশি সহজভাবে হয়ে গেল কি? যে পুরুষ অন্য নারীতে আসক্ত, যার স্ত্রী একা-একা স্বামীর ছেড়ে যাওয়া টিশার্টের গন্ধ নিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে, টেবিলে মুখোমুখি খেতে বসেও যাদের দেড়খানার বেশি কথা বিনিময় হয় না, তাদের ঘরে ফেরা কি এত সহজে হয়? মাদকাসক্ত টুকাইয়ের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাও কি এতটাই সহজ? শ্রীরূপা যেন অকারণেই ডলিকে তার বেডরুমে ডেকে নিয়ে যায়। দর্শকাসনে বসে ব্যাপারটা একটু চোখে লাগে। 

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

অভিনয়ে যে যার জায়গায় যথাযথ। তবে সবচেয়ে বেশী মন কেড়েছেন অর্পিতা। একজন অবহেলিত স্ত্রী ও মানসিক সমস্যায় জর্জরিত মহিলার ভূমিকায় তিনি অনবদ্য। বহু বছর রুপোলি পর্দা থেকে দূরে থেকেও তাঁর অভিনয়ের ধার এতটুকুও কমেনি।

আর ডলিরূপী স্বস্তিকা। তিনি এতটাই মানিয়ে গেলেন যে কোথাও তাঁকে আলাদা করে স্বস্তিকা বলেই মনে হয়নি। সর্বত্রই তিনি যেন রূপ কেয়ারের সেরা সেলস গার্ল। দেবযানীর স্ক্রিন স্পেস এদের দু’জনের চাইতে কিছুটা কম হলেও স্বল্প পরিসরে তিনি নজর কাড়লেন। বাঙালি গৃহবধূর সাজে অসম্ভব সুন্দর লেগেছে দেবযানীকে। প্রথমবার বড় চরিত্রে ঈশান যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। ছোট চরিত্রে অনুভবের অভিনয়ও যথেষ্ট ভালো। ভেঙে পড়ার দৃশ্যে অনুরাধার অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়। ভাল লেগেছে অভিজিৎ ও ছন্দার অভিনয়ও।




তবে ছবির সম্পাদনা আর একটু টানটান হতে পারতো। সৌম্য ঋতের পরিচালনায় ছবির গানগুলির আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। শাওনির গাওয়া ‘রঙ্গ রসিয়া’ অসাধারণ। শীর্ষ সঙ্গীত ‘গুলদস্তা’ও শুনতে ভালো লাগে।

ছোটখাটো ত্রুটি সব ছবিতেই রয়ে যায়, তবে গল্পের স্বার্থে সেসব মেনে নিতেও হয়। ওই স্বল্প সময়ে হয়তো আমরা সকলকে সুখী দেখতে চাই। বাস্তবে রাজপুত্র-রাজকন্যার মিলন আদৌ হয় কিনা জানা নেই, তবে ছবির পর্দায় তা বড়ই কাঙ্খিত। ইদানিং এত জটিল সব ছবির ভিড়ে ‘গুলদস্তা’র মতো মিষ্টি ছবি তৈরি হওয়া যেন বন্ধই হয়ে গেছে। তাই এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে এমন সহজ, সরল, নিটোল একটা গল্প বলার জন্য অর্জুনের প্রশংসা প্রাপ্য।

উল্লেখ্য, গতকাল সন্ধ্যায় ‘গুলদস্তা’ই ছিল গোটা ভারতে আনলক পর্বে প্রেক্ষাগৃহে প্রথম ছবির প্রিমিয়র।  

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *