সংবাদপত্রের শিরোনামই শেষ কথা নয়
ছবি: শিরোনাম
পরিচালনা: ইন্দ্রনীল ঘোষ
অভিনয়ে: যীশু সেনগুপ্ত, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, অঙ্কিতা চক্রবর্তী, সোমা চক্রবর্তী
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৪ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
যে কোনও দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতাটা খুললেই চেখে পড়ে শিরোনাম। কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবরকে পাঠকের সামনে তুলে ধরাই কি এর উদ্দেশ্য? সে খবর কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিচার কে করবে? গোটা দুনিয়ার হাল হকিকৎকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় গণমাধ্যম। আর বর্তমানে তো হাতের স্মার্টফোন খুললেই এক নিমেষে খবর সবার হাতে, বা পকেটে। কিন্তু একটা খবর কতটা সত্যি, সেটার খবর কতজন রাখেন? হয়তো কেউই নয়। আমরা বিশ্বাস করি পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের দেওয়া খবর ভুল হতে পারে না।
সংবাদমাধ্যমের দুটো কাজ। এক, খবর প্রকাশ করা আর দুই, না করা। আর সত্যিটা? সেটার কী হবে? সেই প্রশ্নই তুলে দিলেন ইন্দ্রনীল।
অভিন (যীশু) ছবি তুলতে ভালোবাসে। স্ত্রী আনন্দী (স্বস্তিকা) পেশায় স্থপতি। সেভাবে অর্থ রোজগারে অক্ষম অভিন তাই বন্ধুমহলে একটু একপেশে হয়ে থাকে বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান এবং সুন্দরী স্ত্রীর অধিকারীর তকমা নিয়ে। মুখচোরা, শান্ত, নিজের কাজের প্রতি দুর্বল অভিন যেন এক অন্য ধাঁচের মানুষ। তাই এক বিশিষ্ট সংবাদমাধ্যমের অন্যতম সম্পাদক রজত (অঞ্জন) যখন অভিনকে চাকরির সুযোগ দেয়, সে প্রথমে রাজি হয় না। তারপর রজতে কাছ থেকে যখন জানতে পারে, এই কাজে বেশ অনেকটা দুঃসাহস দরকার, তখন ছবি তোলার তাগিদে সে চাকরিটা নিয়ে নেয়। সাংবাদিকদের জীবনে এমন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট আসে, যেখানে অনেকটা যুদ্ধে যাওয়ার মতোই প্রস্তুতি নিতে হয়। অভিনকে সঙ্গে নিয়ে তার সিনিয়র সহকর্মী সুজিত (শাশ্বত) এক মিশনে বেরিয়ে পরে। দুর্ধষ মাওবাদী নেতা রণছোড়জি এক দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু হঠাৎই বেঁকে বসলেন তিনি। সাক্ষাৎকার না নিয়েই হোটেলে ফিরে আসে সুজিত ও অভিন। সুজিত দুদিন অপেক্ষা করতে চায়। যদি রণছোড়জি মত বদলান। পরের দিন সকালে, কোনও এক পুরোনো মন্দিরের খোঁজ পেয়ে, ছবি তোলার নেশায় অভিন হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। আনন্দীর বারণও সে মানে না।
বিকেল গড়িয়ে রাত নামলেও হোটেলে ফেরে না অভিন। বড় কোনো গন্ডগোলের আশঙ্কায় সুজিত সমস্ত ঘটনা রজতকে জানায়। রজতও তার চ্যানেলে ঘোষণা করে, চিত্রসাংবাদিক অভিন রায় মাওবাদী দ্বারা অপহৃত হয়েছে । টিভিতে এই খবর শুনে আনন্দীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। অন্যান্য চ্যানেল এই খবরের সত্যতা যাচাইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখান থেকেই শুরু হয় ইন্দ্রনীলের ছবি।
পরিচালকের পাশাপাশি প্রশংসার দাবি রাখেন ‘শিরোনাম’-এর কাহিনীকার দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়। প্রতিটি চরিত্র যথাযথ। অভিনয়ে যীশু, স্বস্তিকা, শাশ্বতরা কেউ কাউকে এতটুকু জমি ছাড়লেন না। ক্ষমতালোভী, আগ্রাসী রজতের চরিত্রে অঞ্জন দুর্দান্ত। অঙ্কিতা, শান্তিলাল, সোমার অভিনয় ছবিতে অন্য মাত্রা যোগ করে। ছোট পরিসরে সুজন মুখোপাধ্যায়, শ্রীলা মজুমদার, দেবরঞ্জন নাগ, কাঞ্চনা মৈত্র ভালো। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করছেন রাজা নারায়ণ দেব।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
খবরের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ‘শিরোনাম’। একটা খবর কীভাবে একটা পরিবারে দুর্দশা নিয়ে আসতে পারে, সেটা কজন বিচার করেন? শুধুমাত্র টিআরপি এবং হিটের লোভে সত্যতা যাচাই না করেই যা খুশি জানিয়ে দেওয়া যায় কি? কোথাও গিয়ে অভিন-আনন্দী-সুজিতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবেন দর্শক। আর এখানেই এ ছবি সার্থক। বাস্তবে তো এটাই হয়ে থাকে। বিনোদন এবং মিথ্যে শিরোনামের দাপটে চাপা পড়ে যায় আসল খবর। নাকি তাকে জোর করে চাপা দেওয়া হয়? ক্ষমতার জোরে ছয় কে নয় করে কারা? পাড়ার চায়ের আড্ডায় শিরোনামের বিশ্লেষণ কয়েকদিন পরেই থেমে যায়। আর যে পরিবার বা যাদের কাছের মানুষকে নিয়ে এই শিরোনাম? তাদের খবর কারা রাখে?
ইন্দ্রনীলের ‘শিরোনাম’ প্রাসঙ্গিক। ইন্দ্রনীলের ‘শিরোনাম’ বাস্তব। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত শিরোনামই যে শেষ কথা নয়, সেটাই বুঝিয়ে দেয় এই ছবি।