স্মার্টফোন ও মানবিকতার সহজ কাহিনী

ছবি: ভুবনবাবুর স্মার্টফোন

পরিচালনা: প্রণবেশ চন্দ্র ও শান্তনু বসু

অভিনয়ে: চিন্তা মুখোপাধ্যায়, পরাণ বন্দোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, ঈশান মজুমদার, সিদ্ধার্থ ঘোষ, চন্দ্রনিভ মুখোপাধ্যায়, পত্রালি চট্টোপাধ্যায়, ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, দেবরঞ্জন নাগ, সন্দীপ দে

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, স্কুলজীবনে এরকম রচনা প্রায় সকলকেই লিখতে হয়েছে। বস্তুত ব্যাপারটা আজও আমরা সঠিক জানি না যে বিজ্ঞানের সঙ্গে পায়ে-পায়ে প্রতিদিন এগিয়ে চলা প্রযুক্তি মানব সভ্যতাকে ক্রমশ এগিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিঃশব্দে ঠিক কতটা ক্ষতি করে দিচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক আচরণ, গুণাবলী ও প্রকৃতিকে একটু-একটু করে পাল্টে ফেলছে প্রযুক্তির রঙিন হাতছানি। আমরা এগোচ্ছি ঠিকই, তবু পিছনে ফিরে দেখার কথা আমাদের মনে থাকছে কি? মজাদার গল্পে সেই সতর্কতাবাণীই যেন উঠে এল ছবির পর্দায়।



ছাপোষা মধ্যবিত্ত ভুবনবাবু (চিন্তা)। অফিসে সময়ে কাজ করার ব্যাপারে তার সুনাম আছে। বয়স যতই হোক, কাজের ব্যাপারে তার নামে কোনও অভিযোগ করা যায় না। তবে ভুবনবাবু এই জেট যুগেও টাইপরাইটার ব্যবহার করেন। পুরো অফিসে যুগের নিয়ম মেনে কম্পিউটার এসে গেলেও শুধুমাত্র ভুবনবাবুর জন্য এখনও একটা টাইপরাইটার রেখে দেওয়া হয়েছে। নতুন রিজিওনাল ম্যানেজার রাতুল সরকার (ঈশান) ব্যাপারটা জানতে পেরে হতবাক হয়ে যায়। এরপর আরও বড় ধাক্কা লাগে যখন সে জানতে পারে ভুবনবাবু আজও মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। আজকের দিনে এমন মানুষ বিরল বটে! তবে কড়া ম্যানেজার রাতুলের কাছ এসব স্রেফ কাজে ফাঁকি দেওয়ার অজুহাত। কাজেই একরকম বাধ্য হয়ে নিজের সন্মান রক্ষায় একটি স্মার্টফোন কিনতে হয় ভুবনবাবুকে। তবে ফোন কিনলেই তো হলো না, জানতে হবে তার ব্যবহারও। সাদামাঠা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ভুবনবাবুর জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। ফোনের কারণে বই পড়তে ভুলে যান তিনি। সারাদিন বসের ফোনের ভয়ে অস্থির লাগে।

আরও পড়ুন: নটী বিনোদিনীর চরিত্রে রুক্মিণী?

ওদিকে কৃপাসিন্ধু টেক অ্যাওয়ে সার্ভিস সংক্ষেপে KSTAS নাম দিয়ে মালিক কৃপাসিন্ধু সরখেল (পরাণ) চোরেদের কর্পোরেট সংস্থা চালান। হাইটেক চুরির পদ্ধতি ও ধীরে-ধীরে চৌকস চোর হয়ে ওঠার ব্যাপারে ক্লাস নেন তিনি। রীতিমত পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশনের মাধ্যমে ভাবী চোরদের শেখানো হয় তাদের কর্তব্যকর্ম। এই কর্পোরেট সংস্থায় কাজ করতে গেলে যেমন স্পোকেন ইংলিশ জানা আবশ্যক, তেমনই সনাতন পদ্ধতিতে সিঁধকাঠি ব্যবহারের প্রক্রিয়াও জানতে হয়। তবে দারোগা ভুজঙ্গ দত্ত (খরাজ) বহুদিন ধরেই কৃপাসিন্ধুর সন্ধানে রয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় লোকজনকে চোরের উপদ্রব সম্পর্কে সাবধান করতে গিয়ে ভুবনবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ভুজঙ্গের। স্মার্টফোন নিয়ে জেরবার ভুবনবাবুর বাড়িতে সেদিনই রাতে হানা দেয় কৃপাসিন্ধুর সংস্থার এক চোর।

শান্তনুর ছোটগল্প অবলম্বনে ছবির বিষয় মজার মোড়কে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনভ্যাসের করুণ কাহিনী শুনিয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে যেখানে আজকের প্রজন্ম জ্ঞান হওয়া ইস্তক স্মার্টফোনকে হাতের তালুর মতো চিনে ফেলে, সেখানে আজও বয়স্কদের অনেকের কাছেই এ বড় কঠিন ঠাঁই। সকলে সমান দক্ষতায় প্রযুক্তির এই আশীর্বাদকে প্রতিদিনের জীবনে মেনে নিতে পারেন না, অথচ আশেপাশে সকলেই সেই প্রযুক্তির ভাষায় ভাবতে ও চলতে অভ্যস্ত। এ এক আজব দোটানা।

আরও পড়ুন: ঋত্বিক, উত্তমের পর এবার ভানুর চরিত্রে শাশ্বত

গল্পে অভিনবত্ব রয়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হয়। এরকম একটি বিষয় নিয়ে মূলধারার ছবি করার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন। তবে চিত্রনাট্য আর একটু সচল হতে পারত। ছবির গতি কিছু জায়গায় বেশ শ্লথ লাগে। কৃপাসিন্ধুর কর্পোরেট সংস্থা ও তাদের কর্মকাণ্ড দর্শককে হাসতে বাধ্য করবে। তবু যেন মনে হয় আরও কিছু ঘটতে পারতো। এত সহজে সবটার সমাধান না হলেও চলতো।

থিয়েটার অভিনেতা চিন্তার এটি প্রথম ছবি। দীর্ঘদিন মঞ্চে অভিনয় করার ফলে সেই অভিজ্ঞতার ছাপ তাঁর অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। শুরু থেকে শেষ সবচেয়ে বেশি সময় পর্দায় থেকেছেন ভুবনরূপী চিন্তা। নাটকীয়তা বর্জিত সাবলীল অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন তিনি। অত্যন্ত শক্তিশালী এই অভিনেতাকে আগামীদিনে বাংলা ছবি ব্যবহার করবে বলে আশা করা যায়। কৃপাসিন্ধুর চরিত্রটি লেখক হয়তো পরাণকে ভেবে লেখেননি। তবু ছবি দেখার পর মনে হবে তাঁর জন্যই এই চরিত্র তৈরি হয়েছে। আগাগোড়া রঙিন হাইটেক চোর-সম্রাটের পর্দায় উপস্থিতি দর্শককে ভরপুর বিনোদন দেবে। পরাণ ছাড়া এই চরিত্র আর কেউ করতে পারতেন বলে মনে হয় না।

আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোরে পরমব্রতর নতুন ছবি

ভুজঙ্গের চরিত্রে খরাজ যথারীতি তাঁর নিজস্ব ছাপ রেখেছেন। তবে দারোগার চরিত্রটি আর একটু বড় হতে পারতো। কড়া ম্যানেজারের ভূমিকায় ঈশান অবাক করেছেন। এরকম কোনও চরিত্রে তাঁকে আগে দেখা যায়নি। সফলভাবেই দর্শকের রাগ ও বিরক্তি অর্জন করবে রাতুল চরিত্রটি। চোরের ভূমিকায় সিদ্ধার্থ বেশ ভালো। বাকি অভিনেতারা সকলেই নিজের জায়গায় যথাযথ।

উপল সেনগুপ্তের সুরে ও প্রণবেশের কথায় ‘হ্যালো হ্যালো’ গানটি শুনতে ভালো লাগে। গুণী শিল্পীদের অভিনয়সমৃদ্ধ এই ছবি প্রেক্ষাগৃহে বসে দেখতে ভালোই লাগবে। স্মার্টফোন ও মানবিকতার সহজ কাহিনী হলেও আর একটু ঘটনাবহুল হতে পারতো ছবির গল্প। তবু বিষয়ের গুণে আর পাঁচটা ছবির থেকে কিছুটা আলাদা বলেই স্বতন্ত্রভাবে নজর কাড়বে ‘ভুবনবাবুর স্মার্টফোন’।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *