আজানের সুর আর মঙ্গলারতির শঙ্খধ্বনি মেলালেন শিবু-নন্দিতা

ছবি: গোত্র

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২১ মিনিট

পরিচালনা: নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: অনসূয়া মজুমদার, নাইজেল আকারা, খরাজ মুখোপাধ্যায়, মানালি মনীষা দে, বাদশা মৈত্র, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সাহেব ভট্টাচার্য 

RBN রেটিং: ৩/৫

ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় ভারতবর্ষ মানেই সর্বধৰ্ম সমন্বয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, এ দেশ ‘হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী’ সবার। তা সত্বেও দুটি ধর্মের মধ্যেকার দ্বন্দবিভেদ আজও সমান তালে বহমান। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অঙ্গুলিহেলনের ফাঁদে পা দিয়ে মুছে যাচ্ছে সম্প্রীতি। চেনা সংকীর্ণতার বাইরে বেরিয়ে এসে খোলা মনে জগৎকে দেখা এদের কাছে নৈব নৈব চ। সমাজ সংস্কারের কবচ পরে ও ধর্মের তিলক কেটে থাকা এই মানুষগুলি দিনের পর দিন জাতের নামে বজ্জাতি করে যায়। এই ‘হিন্দু-মুসলমান’ কচকচানি আরও প্রাধান্য পায় সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রোলিংয়ের মাধ্যমে। সেখানে তো একে অন্যকে খাদ্যাভ্যাস নিয়েও কদর্য ভাষায় গালাগাল করতে ছাড়েন না, ভুলে যান রাসপূর্ণিমার চাঁদ আর ঈদের চাঁদে কোনও ফারাক নেই।




মনুষ্যসৃষ্ট এই ‘হিন্দু-মুসলমান’ সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঘেরাটোপে আটকে থাকা সংকীর্ণমনা মানুষদের উদ্দেশ্যেই নন্দিতা-শিবপ্রসাদের নতুন ছবি ‘গোত্র’। মানুষ যখন প্রশ্ন করে, গোত্র কি? ধর্ম কি? ঠিক তখনই এই ছবি তাদের পাল্টা প্রশ্ন করে, মনুষ্যত্ব কি? মানবিকতা কি? ‘গোত্র’ই জানিয়ে দেয় মানুষ যা ধারণ করে তাই ধর্ম, যার সূচনা হয় নিজের বাড়ি থেকেই। অর্থাৎ নিজ মানসিকতা না বদলালে সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন অসম্ভব। তাই তো গোত্রহীন তারেক আলি নিজের গোত্র খুঁজে পায় গোবিন্দধামে।

ন’বছর সংশোধনাগারে থাকা আসামী তারেক (নাইজেল) ফিরতে চায় সমাজের মূলস্রোতে। কিন্তু জেল ফেরত কয়েদিকে বিশ্বাস করে কাজ দেবে কে? অগত্যা পরিচয় লুকিয়ে তারেক পৌঁছে যায় গোবিন্দধামে। ছেলে অনির্বাণ (সাহেব) বিদেশে, প্রাসাদোপম বাড়ি একা সামলান সত্তরোর্ধ মুক্তিদেবী (অনসূয়া)। স্বভাবে বাতিকগ্রস্ত এই ‘হিটলার মাসিমা’র কাছে কোনও পরিচারক টিকতে পারে না। কিন্তু শেষমেশ মুক্তিদেবী জব্দ হন তারেক বা তাঁর তারকের কাছে। বাড়িতে কখন কে আসবে যাবে তার তীক্ষ্ণ নজর রাখে তারেক। বাড়ির প্রতিষ্ঠিত গোবিন্দকে ভোগ না দিয়ে মুখে অন্ন তোলেন না মুক্তিদেবী। ফলত তাঁর কাছে লুকোতে হয় তারেকের ধর্ম পরিচয়ও।

আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

হিউস্টন প্রবাসী ছেলের ঠিক করে দিয়ে যাওয়া এই পরিচারক আর তাঁর আরেক সঙ্গী ঝুমাকে (মানালি) নিয়ে দিব্যি দিন কাটতে থাকে মুক্তিদেবীর। তারেকের মধ্যে তিনি খুঁজে পান তাঁর আরেক সন্তানের মায়া। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় গোবিন্দধামকে ঘিরে। একা বৃদ্ধা ও তাঁর সুবিশাল সম্পত্তির ওপর দৃষ্টি পড়ে এলাকার প্রমোটার শকুন বাপির (খরাজ)। গোবিন্দধাম দখল করার জন্য সে হাত মেলাতে চায় তারেকের সঙ্গে। আর এখানেই ঘুরে যায় গল্পের মোড়।

শিবু-নন্দিতার ছবিতে সাধারণত একটি সামাজিক বার্তা থাকে। ‘গোত্র’ও তার ব্যতিক্রম নয়। মুসলমান তারেক কি আদৌ কৃষ্ণভক্ত মুক্তিদেবীর ছেলে হয়ে উঠতে পারবে, সে গল্পই বলে এই ছবি।

অভিনয়ে প্রত্যেকেই যথাযথ। অনসূয়ার মাতৃস্বরূপা স্নিগ্ধ উপস্থিতি মন ভালো করে দেয়। তবে বিশেষ ভাবে নজর কেড়েছেন নাইজেল। মিতভাষী, গম্ভীর স্বভাবের তারেকের চরিত্রটি সুনিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অভিব্যক্তির সাহায্যে। ঝুমার চরিত্রে মানালিকে দর্শক মনে রাখবেন। ভালো লাগে ঝুমা-তারেকের খুনসুটির মহুর্তগুলি। মাসিমার ‘বয়ফ্রেন্ড’ হিসেবে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন সন্তু মুখোপাধ্যায়। বাড়ির পুরোহিতের ভূমিকায় অম্বরীশের কমিক টাইমিং অসাধারণ। শকুন বাপি হিসেবে খরাজের চারিত্রিক ক্রুরতা প্রশংসনীয়। বেশ অনেকদিন পর খরাজকে এই ধরণের চরিত্রে দেখা গেল। মুক্তিদেবীর ছেলের চরিত্রে সাহেব এবং পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় বাদশা যথাযথ।

আরও পড়ুন: গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই

তবে ছবিতে এতগুলি গানের বোধহয় প্রয়োজন ছিল না। মুক্তিদেবীর চরিত্র এমনিই ছবিতে পরিস্কার। তার জন্য আলাদা গান অযথাই ছবির দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছে। ছবির দ্বিতীয়ার্ধ তুলনামূলক ধীর। বেশ কিছু জনপ্রিয় আঞ্চলিক গানের আধুনিকীকরণ করেছেন ছবির সঙ্গীত পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ইমন চক্রবর্তী ও সুরজিতের কন্ঠে ‘রঙ্গবতী’ ইতিমধ্যেই তার রঙ ছড়িয়েছে দর্শকমহলে। অরিজিত সিং-এর ‘মা’ গানটি দুর্দান্ত। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান ‘অষ্টতর শতনাম পেল নারায়ণ’ এই ছবিতে অদিতি মুন্সির কণ্ঠে হয়ে উঠেছে ‘অষ্টতর শতনাম নিল নারায়ণ’।

সব মিলিয়ে সমকালীন চিত্রপটের চেনা ছবি ‘গোত্র’। একটা ছবি তৈরি করে সাম্প্রদায়িক বিভেদ মেটানো যায় না। শিবু-নন্দিতা বিলক্ষণ জানেন সেই কথা। তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, সব গোত্রের থেকে বড় গোত্র মনুষ্যত্ব আর সব ধর্মের চেয়ে বড় ধর্ম মানবিকতা। সেই কাজে তাঁরা সফল।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *