ভালো গানের সঙ্গে পাওনা প্রাপ্তমনষ্কতা
ছবি: ঘরে ফেরার গান
পরিচালনা: অরিত্র সেন
অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ইশা সাহা, গৌরব চট্টোপাধ্যায়, রেশমী সেন, চৈতালি দাশগুপ্ত
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২২ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যে দু’রকম সত্তা থাকে। এক, বাইরের লোকের জন্য, যেখানে সকলেই ভদ্রতা, সভ্যতা, শালীনতা বা আদব-কায়দা রক্ষা করে চলে। আর দ্বিতীয়, যেটা এইসব খোলসের ভেতরে থাকা মানুষটার আসল রূপ। প্রিয়জন বা কাছের মানুষদের জন্য থাকে মুখোশ এবং মেকআপবিহীন আসল চেহারা। দিনের শেষে ওই খোলসটা ছেড়ে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া খুব জরুরি। তবু যদি বাড়ির লোকের সামনে বা বন্ধুবৃত্তেও নিজেকে সাজিয়ে পেশ করতে হয়? সর্বক্ষণ অন্যের হিসেবে নিখুঁত হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হয় বা নিজে যা নয় তাই হয়ে দেখাতে হয়? বলা বাহুল্য এভাবে মনকে খাঁচায় বন্দী করে বেশিদিন রাখা যায় না। কারণ এভাবে বাঁচতে গিয়ে নিজের ভেতরের আমিটা প্রতিদিন মরে যেতে থাকে।
যেমনটা হয়েছিল তোড়ার। কিছুটা পরিস্থিতির চাপে পড়েই তোড়ার (ইশা) বিয়ে হয় ঋভুর (গৌরব) সঙ্গে। ঋভু লন্ডন অধিবাসী ডাক্তার। তার মা শান্তা (রেশমী) লন্ডনের মেয়র কাউন্সিলের সদস্য এবং ফ্যাশন ডিজ়াইনার। দুজনেই প্রচন্ড ব্যস্ত এবং কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ, কিছুটা জটিলও। এদের গাম্ভীর্যের মাঝে পড়ে সহজ, সরল তোড়া দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাস্তবে যেমন সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি নতুন সংসারে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে, সেভাবেই নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে অন্যের মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে সে। কিন্তু কতদিন? ক্রমশ তার অস্তিত্বের সংকট দেখা দিতে থাকে। একদিকে ইমরানের (পরমব্রত) সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাওয়ার অদম্য আকর্ষণ অন্যদিকে পরিবারের কড়া অনুশাসন, কোনটা বেছে নেবে তোড়া?
আরও পড়ুন: ৩৪ বছর পর একসঙ্গে ‘রামায়ণ’ জুটি
মফস্বলের মেয়ের বিদেশে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার গল্প বলতে চেয়েছেন অরিত্র। প্রত্যাশামতোই ঝকঝকে এবং স্মার্ট ছবি। দেখতে বসে ক্লান্ত লাগে না। তবে যে কথা সবথেকে আগে বলা দরকার তা হলো এই ছবির শুরু এবং শেষ গান দিয়েই। দুটোই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। এছাড়াও গোটা ছবি জুড়ে অজস্র ভালো গানের আনাগোনা লেগেই থাকে। ইমরান ও তোড়া দুজনেই যেহেতু সঙ্গীতশিল্পী তাই এই ছবি গানের হবে সেটা জানাই ছিল। যেটা অবাক করে সেটা হলো গানের ব্যবহার। প্রতিটা গান ছবিতে এসেছে প্রয়োজন বুঝেই। কোথাও গানকে আরোপিত মনে হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীত হোক বা লোকগান, কিংবা মৌলিক গান সবটাই শুনতে এবং দেখতেও ভালো লাগে।
আরও পড়ুন: রিভুর ছবিতে অমিতাভ
তার থেকেও বড় কথা, গান কিছুটা করে গল্পকেও এগিয়ে দেয় এখানে। গান মানেই কখন শেষ হবে, ছবি কখন শুরু হবে, এই অপেক্ষাটা করতে হয় না। অনেকদিন পর বেশ কিছু মন ভালো করা লোকগান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা গেল এই ছবিতে যেগুলো খুব চেনা বা মোটামুটি চেনা হলেও তার উপস্থাপনার জোরে শুনতে নতুন লাগে। বাংলা ছবিতে গান বা বলা ভালো প্লেব্যাক আবার ফিরতে দেখে সত্যি ভালো লাগে।
ছবির গল্পে যেটা সবচেয়ে বেশি করে বলার, সেটা হলো প্রাপ্তমনস্কতা। ওয়েব সিরিজ়ের যুগে নৈতিকতার বক্তৃতা আর চলে না। তাই বিবাহসূত্রে সঙ্গী মানুষটিকে ভিলেন না বানিয়েও বিচ্ছেদ দাবি করা যায়। দুটো মানুষের একসঙ্গে থাকতে না পারার কারণ শুধুমাত্র সঙ্গতি বা সামঞ্জস্যের অভাবটুকুই, এর বাইরে আর কিছু নাই হতে পারে, এটা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন অরিত্র। তোড়ার চরম সিদ্ধান্তের মুখেও তাই ঋভুর জন্য একটু খারাপই লাগে। দোষ একা তার ছিল না। দোষ তোড়ারও ছিল না। সে শুধু নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আশায় ভুল পথে গেছে বারবার। তবু হাল ছাড়েনি। এমনকি অচেনা বিদেশেও নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে ভোলেনি।
ছবির প্রথমার্ধ আর একটু গতিময় হতে পারত। দৈর্ঘ্যও কমানো যেত কিছুটা। একই ধরণের বেশ কিছু দৃশ্য হয়তো সম্পাদনা করা যেত। ছবির শেষের দিকে ঘটনার ঘনঘটায় কিছু জায়গা আরোপিত লাগে। আবার যেখানে ইমরান ও তোড়ার ঘনিষ্টতা কিছুটা সময় দাবি করে তা দেখানো হলো বড়ই তাড়াতাড়ি। ছবির শেষ দৃশ্য মেলোড্রামা বর্জিত, এবং সেই কারণেই ভারী সুন্দর। পরিচালকের পরিমিতিবোধকে সাধুবাদ। এছাড়াও এই ছবিতে নারী চরিত্রের দুটি বিপরীত রূপ উঠে এসেছে গল্পের প্রয়োজনেই। তোড়ার চরিত্র খুব বাস্তব এবং বিশ্বাসযোগ্য। চারিত্রিক দিক দিয়ে একটু এলোমেলো এবং দুর্বল মানুষ এভাবেই নিজেকে ঘেঁটে ফেলে একটা সময় অসহায় বোধ করে। উল্টোদিকে দৃঢ় চরিত্রের শান্তা মানুষ হিসেবে যেমনই হোক তার চরিত্রের কাঠিন্য উঠে আসে তার সমস্ত আচরণের মধ্য দিয়ে। ঋভুর চরিত্রটি তার স্বকীয়তা নিয়েই স্মার্ট এবং সপ্রতিভ। প্রয়োজনে সে নিজেকে ভাঙতেও দ্বিধাবোধ করে না। তুলনায় ইমরান কিছুটা একমাত্রিক। জীবনে গান এবং প্রেম ছাড়াও অনেক কিছু থাকতে পারে, সেটার কিছুটা অভাববোধ রয়ে গেল ইমরানের চরিত্রে। হিদারের চরিত্রটি বন্ধু হিসেবে আগাগোড়াই খুব সুন্দর।
আরও পড়ুন: সম্পর্ক অস্বীকার জ়িনতের
অভিনয়ে সকলেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন তাঁদের নিজগুণে। ইশার অভিব্যক্তি পরিমিত এবং স্বচ্ছ। চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গিয়েছেন তিনি। তবে গানে ঠোঁট মেলানোর ব্যাপারে আর একটু কম সতর্কতা দেখালে ভালো লাগত। এমন নয় যে তোড়া প্রথম গান গাইছে। মঞ্চে গান গাইতে অভ্যস্ত শিল্পীর শরীরী ভাষা আরও সহজ হওয়া উচিত ছিল। ইমরানের চরিত্রে পরমব্রত বেশ ভালো। চরিত্রটি তাঁকে ভেবেই লেখা হয়েছে সেটা বোঝা যায়। ইমরানকে আর কোনও অভিনেতা এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন কিনা সন্দেহ। ভালো লাগে গৌরবকে দেখতে, এবং শুনতেও। চোস্ত ব্রিটিশ উচ্চারণ এবং সেই টানে বাংলা বলা ঋভু চরিত্রটিকে বাস্তব করে তোলে। শান্তারূপে রেশমী এখানে বেশ অচেনা। এমন কঠিন চরিত্রে সাধারণত তাঁকে দেখা যায় না। নিজের মতো করে শান্তাকে সাজিয়ে তুলেছেন তিনি, এবং সত্যিই অবাক করেছেন। অবাক করেছেন চৈতালিও। সুন্দর মানিয়ে গিয়েছেন এক অপ্রত্যাশিত চরিত্রে।
এই ছবির এক এবং একমাত্র সম্পদ হলো গান। সেই গানকে প্রবুদ্ধ বন্দোপাধ্যায়ের পরিচালনায় অসম্ভব প্রাণময় করে তুলেছেন তিমির বিশ্বাস ও সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো ছাড়াও ‘বসন্ত বাতাসে’ এবং ‘অমৃত মেঘের বারি’ শুনতে খুব ভালো লাগে। এছাড়াও ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে’ গানটির সঙ্গীতায়োজন প্রসংশনীয়। চিত্রগ্রহণ যুগোপযোগী। পোশাক পরিকল্পনা তারিফের দাবি রাখে।
সব শেষে বলাই যায়, বসন্তের দিনে মহীনের ঘোড়াগুলির নস্টালজিক কথায় ভর করে একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে এই আগাগোড়া ভালোবাসার ছবি দেখে এলে মন ভালো হয়ে যেতে পারে।