আধিদৈবিক প্রেক্ষাপটে ধোঁয়াশা রেখে যায় তন্ত্রের ধারণা

ছবি: পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ (উত্তর আসবেই)

পরিচালনা: রাজর্ষি দে

অভিনয়ে: পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রাজেশ শর্মা, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, দামিনী বসু, সুচন্দ্রা ভানিয়া, আরিয়ান ভৌমিক, গৌরব চক্রবর্তী, ঈশিকা দে

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৮ মিনিট 

RBN রেটিং: ৩/৫

অতিলৌকিক, অলৌকিক কিংবা আধিদৈবিক। শব্দগুলির অর্থ এক কথায় বোঝানো সম্ভব নয়। যেমন বোঝা সম্ভব নয় তন্ত্রসাধনার দর্শনকে। এও এক ধরণের ঈশ্বরচিন্তা, শুধু এর পথ অন্য। ঈশ্বরকে পাওয়ার, তার সঙ্গে মিলনের তীব্র আকাঙ্খা টেনে নিয়ে যায় তন্ত্রের দিকে। তন্ত্রসাধনা নিয়ে নানারকম মত প্রচলিত আছে। সেগুলি ঠিক না ভুল সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায় তন্ত্র মানেই ভয়াবহ একটা ব্যাপার, এরকম একটা ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে। সে ধারণা খুব একটা ভুল বলা চলে না, তবে এও বলা যায় যে তন্ত্র সাধনা মানুষের কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রেও উপযোগী হতে পারে, এবং তাই কাম্য। বরং ভুল প্রয়োগে এবং অসাধু উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার করলে তার ফল হতে পারে মারাত্মক। সে ভয়াবহতার কথা সংসারী মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। তেমনই তন্ত্র সম্বন্ধে কোনও ধারণা না থাকলে সবটাই এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা মনে হতে পারে।




ঠিক তেমনটাই হলো এই ছবির ক্ষেত্রে। ‘পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ (উত্তর আসবেই)’-এর চিত্রনাট্য লিখেছেন উপাসনা চৌধুরী, অভীক সরকার ও রাজর্ষি। অভীকের ‘এবং ইনকুইজ়িশন’ অবলম্বনেই এই ছবি। তিনটি ভাগে ভাগ করা এই ছবির গল্প। এই তিনটি গল্পই ট্রেনে করে ভেলোর যাওয়ার সময় স্তুতিকে (অর্পিতা) শোনান ট্রেনের অচেনা আগন্তুক (কমলেশ্বর)। যেহেতু গল্প তিনটি তাই আলাদাভাবে তিনটির আলোচনা করাই যায়।

প্রথম গল্প ‘শোধ’। কাহিনীর প্রেক্ষাপট ব্রিটিশ শাসিত মুঘল ক্ষমতার সূর্যাস্তের সময়ের ভারত। সেই সময় ইংরেজদের বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল ঠগীদের উৎপাত। বিদেশী পথিকদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে প্রচুর লুটপাট চালাতো ঠগীরা। তাদের সর্দার দুর্গাশঙ্কর পন্ডিত। ঠগীদের মূল নেতা হলেও তার এক রহস্যময় অস্তিত্ব আছে যা তার সঙ্গীসাথীদের কাছেও অজ্ঞাত। পথচলতি কোনও বড় দলের ওপর আক্রমণ করে তাদের হত্যা করার পরে গণকবর দেওয়ার সময় প্রতিবার একটি করে মৃতদেহ চেয়ে নেয় দুর্গাশঙ্কর। তারপরে সেই মৃতদেহ নিয়ে সে কী করে তা কেউ জানে না। বিপুল সংখ্যক টিপুশাহী মুদ্রা নিয়ে ডুলি চড়ে যাওয়ার সময় এভাবেই আক্রান্ত হন আহমেদ শাহ ও তার সঙ্গীরা। এই পর্বের গল্প এই অবধি টানটান। কিন্তু শেষটা হয় হঠাৎই। স্পষ্ট হয় না দুর্গাশঙ্করের পরিণতি, কিংবা মুন্নীর ডাকের অর্থ। এই পর্বের অভিনয়ে রাজেশ শর্মা প্রত্যাশামতোই পিশাচসিদ্ধ যোগীর মূর্ত রূপ দিয়েছেন। তবে তাঁর পরিসর বেশ কম ছিল। 

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

পরের গল্প ‘রক্তফলক’ তিতলি (সুচন্দ্রা) নামের একটি মেয়েকে নিয়ে। তিতলির ওপর রয়েছে দেবীর আশীর্বাদ। সে মানুষকে অপশক্তি থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। তিতলির সঙ্গে স্যামের (আরিয়ান) আলাপ সোশ্যাল মিডিয়াতে। তাকে কখনও সামনাসামনি দেখেনি তিতলি, তবু তার এককথায় জ্যেঠু জেঠির (পদ্মনাভ ও বিদীপ্তা) বাড়ি ছেড়ে সে দুই বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। স্যামকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায় তিতলি। কিন্তু স্যাম কি চায়? আসলে সে কে? শতাব্দী প্রাচীন এক কাহিনী এসে পড়ে এখানে। দুই বংশের ইতিহাস ও অভিশাপের গল্প শোনা যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের (পরাণ) মুখে। এই চরিত্রটি অদ্ভুতভাবে তিনটি গল্পেই এসে পড়েন যদিও তিনটি কাহিনীর সময়কাল ভিন্ন। কৃষ্ণানন্দ তন্ত্র সাধনার এক মহান সিদ্ধপুরুষ। বজ্রযোগিনীর সঙ্গে ছিন্নমস্তার যে সাদৃশ্য তা দর্শকমাত্রেই বুঝতে পারে, কিন্তু বিদীপ্তার চরিত্র প্রবল ঈশ্বরভক্ত হয়েও কেন তা চিনতে পারেন না বোঝা গেল না। এছাড়া এক অচেনা ফলককে বাড়িতে ঠাকুরের আসনে জায়গা দেওয়া বেশ অদ্ভুত ঠেকে। সচরাচর গৃহস্থ মানুষ এমনটা করবেন না। এই পর্বের শেষ কি হতে চলেছে তা আগে থেকেই বোঝা যায়, তবে ঘটনার ব্যাখ্যা আর একটু প্রাঞ্জল হলে দর্শকের বুঝতে সুবিধা হতো। অভিনয়ে সুচন্দ্রা, আরিয়ান, বিদীপ্তা ও পদ্মনাভ যথাযথ। 

আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে

তৃতীয় গল্প ‘ভোগ’। এটি এই সিরিজ়ের শ্রেষ্ঠ গল্প বলা যায়। ছবিতেও এই গল্পটি সবথেকে ভয়ঙ্করভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। অতীনের (গৌরব) সাদামাঠা জীবনকে পাল্টে দেয় একটি নিরীহ মূর্তি যাকে সে এক কিউরিও শপে খুঁজে পায়। নিছক কৌতূহল বশে অনেকটা সরস্বতীর মতো দেখতে সেই মূর্তিকে বাড়িতে আনার পর সবকিছু কেমন যেন পাল্টে যায়। আগাগোড়া শৌখিন অতীন একমুখ দাড়ি নিয়ে নোংরা জামাকাপড় পরে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়। পিতৃস্থানীয় কাকা (রুদ্রপ্রসাদ) ও বাড়ির পুরোনো কাজের লোক পুষ্পদির (দামিনী) বারণ সত্বেও বাড়িতে সে এনে তোলে অপরিচ্ছন্ন চেহারার এক অদ্ভুত মহিলা ডামরীকে (ঈশিকা)। এই ডামরী আসার পর অতীনের সর্বস্ব যেন একে একে হারিয়ে যেতে থাকে। অথচ সমস্ত দিক থেকে অশুভ লক্ষণযুক্ত ডামরী রান্না করে ভোগ দিলেই একমাত্র সেই অচেনা দেবী ভোগ গ্রহণ করেন। রহস্য খুঁজতে কাকা পৌঁছে যান বামনগাছির সেই জমিদার বাড়িতে যেখান থেকে এই মূর্তির আমদানি হয়েছিল। জানা যায় এই মূর্তির নাম মাতঙ্গী। দশমহাবিদ্যার এক রূপ এই দেবী। বৌদ্ধ মতে তন্ত্র সাধনায় এই দেবীর অস্তিত্ব রয়েছে, তবে এর পূজার নিয়ম বড় অদ্ভুত ও কঠিন। সঠিকভাবে পূজা না করলে দেবীর অপশক্তিতে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটতে পারে। অবশেষে আবারও কৃষ্ণানন্দের আবির্ভাব ও কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে। এই পর্বে ডামরীর ভূমিকায় ঈশিকা অনবদ্য। এছাড়া গৌরব, রুদ্রপ্রসাদ ও দামিনীকেও ভালো লাগে। যোগী পুরুষের ভূমিকায় পরাণ চরিত্রটির প্রতি সুবিচার করেছেন। ভয়াবহতার দিক দিয়ে এই পর্বটি মনে ছাপ রেখে যায়। 

আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে

তিনটি পর্ব মিলিয়ে যা বলা যায় তা হলো ‘এবং ইনকুইজ়িশন’ পড়া না থাকলে এই ছবির অর্থ বুঝতে বেশ বেগ পেতে হবে। তন্ত্র সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্বাস ছাড়া এই ধরণের গল্প গাঁজাখুরি মনে হবেই। আর অভীক যেভাবে তিনটি কাহিনীকে ধীরে ধীরে বিস্তার করেছেন তাতে করে এত অল্প পরিসরে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা ছাড়া গল্পগুলি সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা বৃথা হতে বাধ্য। ব্যাপ্তির দিক থেকে প্রত্যেকটি গল্প নিজেই একটি ছবি হওয়ার দাবী রাখে। তন্ত্রমতে সবকটি কাহিনীর সঠিক ব্যাখ্যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না পেলে দর্শকের তেষ্টা মিটবে না। তবে তিনটি একেবারে অন্য ধরণের অতিলৌকিক কাহিনীকে ছবির পর্দায় ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিচালককে কুর্নিশ জানাতেই হয়। যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন ছিল এই কাহিনীর চিত্রায়নের ক্ষেত্রে। দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহ সঙ্গীত ভালো, তবে গানগুলির কোনও প্রয়োজন ছিল না। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *