আপন হতে বাহির হয়ে
ছবি: লা পাত্রি—হোমল্যান্ড
পরিচালনা: অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অ্যানি হভ্যনিসিয়া, জনাথন দুমন্তিয়্যর, সিলভি দ্য নেফ, প্রকাশচন্দ্র রায়
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ১২ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
ফ্রান্সের ছোট্ট গ্রাম কমার্সি। ফরাসী বংশোদ্ভুত আর্মেনিয়ান মা-বাবার কাছে তাঁদের জন্মভিটের গল্প শুনে, অদম্য উৎসাহে আবেগতাড়িত হয়ে অ্যানি এসে পৌঁছয় সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এই গ্রামে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কমার্সিতে বসবাসকারী জনাথনের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর, মা-বাবার সেই ছোট্টবেলার গ্রাম স্বচক্ষে দেখার সুপ্তবাসনা তীব্র হয়ে উঠেছিল অ্যানির। এই গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে অ্যানির মা-বাবার জন্ম, বেড়ে ওঠা, শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি। মায়ের কাছে রূপকথার গল্পের মতো শোনা সেই গ্রামের ছোট্ট সাজানো গির্জা, সিমেট্রি, পাশ দিয়ে বয়ে চলা শান্ত নদী এই সবকিছুই কল্পনার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করত অ্যানি।
অন্যদিকে, ভারতীয় তরুণ গঙ্গা কাঁটাতার ভুলে সুরের ভেলায় ভেসে চলেছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। গোটা মানচিত্র জুড়ে আঁকা লাল-নীল-হলুদ-সবুজ সব দেশগুলোই তার কাছে ‘হোমল্যান্ড’। কলকাতা থেকে মুম্বই তারপর বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া হয়ে প্যারিসের রাস্তায় দিকভ্রষ্ট অ্যানির সঙ্গে একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে যায় গঙ্গার। অ্যানি জানতে পারে যে গঙ্গা বেশ কিছুদিন ধরে প্যারিসের রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, গান গাইছে, নদীর ধারে বসে ছবি আঁকছে। তার নাকি পাসপোর্ট, ভিসা কিচ্ছু নেই। এই অবিশ্বাস্য তথ্য জানতে পেরে ছেলেটির সঙ্গে অ্যানির পরিচয় করার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। বলতে গেলে এখান থেকেই শুরু ‘লা পাত্রি’র গল্প। একটা সময় ‘হোমল্যান্ড’ শব্দটির পিছনে তার নিরন্তর ছুটে চলার কারণ অ্যানি জানায় গঙ্গাকে। অথচ গঙ্গার বিচারে গোটা পৃথিবীটাই তার কাছে বাসভূমি, তার ‘লা পাত্রি’।
ছবির পটভূমি ফ্রান্স। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই ছবিতে ফরাসী ভাষার প্রাধান্য বেশি। তবে বেশ কয়েকটি দৃশ্যে আর্মেনিয়ান, বাংলা, স্প্যানিশ, আরবি ভাষার যথাযথ ব্যবহার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিরন্তর বয়ে চলা ‘গঙ্গা’র চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এককথায় অনবদ্য। তাঁর সাবলীল অভিনয়ের জন্যই ছবিটা দেখা যায়। নিজের নামের চরিত্রে অ্যানি হভ্যনিসিয়া সপ্রতিভ। অন্যান্য চরিত্রে জনাথন, সিলভি, প্রকাশচন্দ্রের অভিনয় তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। ছবির চিত্রনাট্য এবং সংলাপ লিখেছেন সোমঋতা ভট্টাচার্য এবং পরিচালক নিজে। তবে একই সংলাপ একাধিকবার ব্যবহৃত হওয়ার ফলে ঘটনার গুরুত্ব একটু হলেও হ্রাস পায়। দর্শকের কথা মাথায় রেখে ছবির গতি একটু বাড়াতে পারতেন অনিন্দ্য। আইজ়্যাক টুলিদু পাওলো, নিকোলাস ভার্ট এবং আলম খানের সিনেমাটোগ্রাফি বেশ ভালো। শুনতে ভালে লাগে জন লেননের ‘ইমাজিন’ যা এই ছবির জন্য একেবারে উপযুক্ত। অলকানন্দা দাশগুপ্তের আবহ, এবং অগ্নিমিত্রা পলের পোশাক পরিকল্পনা যথাযথ।
অনিন্দ্যর এই ‘হোমল্যান্ড’ আসলে একটা বোধ, একটা অনুভূতি। অভিধান ঘেঁটে যে ‘বোধ’কে আত্মস্থ করা অসম্ভব। গঙ্গানদীর মতো অবিরাম বয়ে চলাই ‘গঙ্গা’র জীবনের মূলমন্ত্র। আর সেখানেই তার নামকরণের স্বার্থকতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবে লিখেছিলেন ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’। ছোট-ছোট অনুভূতি, আবেগ, দ্বন্দ্ব, সারল্য, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে ভালবাসার শহরে তৈরি এই ছবি। কাঁটাতারের বেড়াজাল অদৃশ্য করে, এই ধরিত্রী যে আমাদের জন্মভূমি তা আরও একবার মনে করিয়ে দেয় ‘লা পাত্রি’।