ঝরঝরে, টানটান, স্মার্ট
সিরিজ়: মহানগর
পরিচালনা: আশফাক নিপুণ
অভিনয়ে: মোশারফ করিম, জ়াকিয়া বারী মম, শ্যামল মাওলা, মোস্তাফিজ়ুর নূর ইমরান, খায়রুল বাশার, নিশাত প্রিয়ম
দৈর্ঘ্য: ৪ ঘটা (আট পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
দেশের রাজধানী মানেই বড় শহর। সেই বড় শহরের আনাচে কানাচে রোজ ঘটে যায় হাজারো ঘটনা, যার থেকে প্রতিনিয়ত তৈরি হয় নতুন রঙের গল্প, আঁকা হয় জীবনের কোলাজ। আবার একইসঙ্গে চাপা পড়ে যায় অজস্র অসহায় মানুষের আর্তনাদ, দাবিয়ে দেওয়া হয় সত্যি বলতে চাওয়া সমস্ত গলার স্বর। এ এক আজব মেশিন যেখানে চাইলেই মিউট বোতামটি টিপে সৎ ও নিরীহ মানুষের সরল স্বীকারোক্তিকে বন্ধ করে দেওয়া যায়। এর নাম রাষ্ট্রযন্ত্র, এরই নাম সিস্টেম। আবার নামান্তরে একেই হয়তো ন্যায়বিচার বলে।
আধুনিক জনবহুল ঢাকা শহরের এক সন্ধ্যে। চলছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের দুটি নৈশভোজের পার্টি, যেখানে চোখে-চোখে ঘটে যায় নানা সমীকরণ। কোথাও বা নতুন ফুল ফোটার সম্ভাবনা দেখা যায় আবার কোথাও চলে পেশিশক্তির আস্ফালন। একদিকে যেমন কর্পোরেট চাকুরে আবির (খাইরুল) আর রুমানার (নিশাত) মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, অন্যদিকে প্রভাবশালী বাবার ছেলে নামী শিল্পপতি আফনান (শ্যামল) অযাচিত বচসায় জড়িয়ে পড়ে।
একসময় পার্টি ভাঙে। যে যার সঙ্গীর সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথ ধরে। এই পথেই ঘটে যায় কাহিনীর মূল ঘটনা। আফনানের গাড়ি এক সাধারণ সাইকেল আরোহীকে ধাক্কা মারে এবং লোকটি মারা যায়। পুলিশ আফনানকে থানায় নিয়ে এলেও ছোটখাটো জেরা ছাড়া তার ওপর বিশেষ কোনও জোর খাটায় না। কারণ তিনি প্রতিপত্তিশালী মানুষ। প্রায় বিনা দোষে আবিরকেও রাস্তা থেকে তুলে আনে পুলিশ। স্বভাবশান্ত শিক্ষিত ভদ্র আবির লজ্জায় মুখ খুলতে পারে না। আর এই সমস্ত কর্মকাণ্ড ঘটে অফিসার ইন চার্জ হারুন অর রশীদের (মোশারফ) তত্ত্বাবধানে। আপাদমস্তক একজন অসৎ ইন্সপেক্টর হয়েও শুধু নিজের পদমর্যাদার জোরে সকলকে দাবিয়ে রাখেন হারুন। সব দেখেশুনেও কিছুই করতে পারে না সাবইনস্পেক্টর মলয় (ইমরান)। তার হাতপা বাঁধা। এমনকি দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শান্তকেও ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দেয় হারুন।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
‘দুইটা’ পথের কথা বলা হারুনের নিজের পথ একটাই, ঘুষ। সমস্ত ঘটনাটা অন্যভাবে সাজিয়ে ফেলার জন্য আফনান ও তার বাবার সঙ্গে বিশ লাখে রফা করেন তিনি। সেই উদ্দেশ্যে অনেকটা এগিয়েও যান। তারপর? একটা গোটা রাত ধরে কোতোয়ালি থানায় চলতে থাকে নাটকের পর নাটক। অদৃশ্য লেখকের হাতে বারবার তার চিত্রনাট্য বদল হয়। অপ্রত্যাশিতভাবে থানায় এসে পৌঁছন সহকারী পুলিশ কমিশনার শাহানা (জ়াকিয়া)। হারুনকে কি তিনি থামাতে পারেন? আফনান কি সব সত্যি জানিয়েছে আদৌ? চাপা উত্তেজনায় কাটতে থাকে সে রাতের প্রতিটা মুহূর্ত।
এদিকে বিখ্যাত লোকের গ্রেফতারির জেরে খবরের গন্ধে বাইরে অপেক্ষায় রয়েছে অসংখ্য সাংবাদিক। কীভাবে শেষ হয় সেই রাত তা জানতে গেলে ধৈর্য নিয়ে দেখতে হবে এই সিরিজ।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
পুলিশি অত্যাচারের এক নির্মম রূপ দেখানোর পাশাপাশি সৎ পুলিশ অফিসারের নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা এবং সময়বিশেষে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ঘটনার বিনির্মাণ বুঝিয়ে দেয় পুলিশ চাইলেই অপরাধের শিকড় পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু সবসময় পুলিশও কি তা চায়? যথার্থই কখনও-কখনও দুই আর দুই চার নয়, প্যাঁচও হয়।শেষে একটাই প্রশ্ন থেকে যায়, নির্দোষ নিরীহ মানুষকে অকারণে থানায় টেনে নিয়ে গিয়ে যেভাবে হয়রানি করা হয় সেটা কি সত্যি তাদের প্রাপ্য? নাকি ন্যায়বিচারের সঙ্গে এসব কোল্যাটরাল ড্যামেজ সব দেশকালেই অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা?
‘মহানগর’-এ চিত্রনাট্যই নায়ক। নিপুণের লেখা কাহিনী চার ঘন্টা দর্শককে এক জায়গায় আটকে রাখে। তেমনই তাঁর পরিচালনা। ঝরঝরে, মেদহীন এবং অসম্ভব স্মার্ট। তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন প্রত্যেক শিল্পী। ছবির শেষ চমক বলে দেয় শুধু ওপারেই নয়, এপার বাংলার দর্শকও তাঁর পরবর্তী কাজের অপেক্ষায় থাকবে। নাহলে এতটা সময় ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকার পরও দ্বিতীয় সিজ়ন দেখার জন্য আগ্রহ থাকতো না।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
আগাগোড়া পূর্ববঙ্গীয় টানে বলা সংলাপ সম্ভবত সিরিজ়ের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে আবিরকে প্রথমবার থানায় নিয়ে আসার জন্য আরও বিশ্বাসযোগ্য কোনও কারণ দেখানো উচিত ছিল। বিশেষত যখন ভিআইপি কেসের খবর ফোন মারফত হারুনের কাছে আসে, তখন এসব ছোটখাটো ঝামেলা তিনি থানা অবধি টেনে নিয়ে যাবেন কেন? আর আবিরের মানিব্যাগেও তেমন কিছু ছিল না। এছাড়া শুরুতে জয়নালকে খুঁজতে গলিপথে খোদ ওসির যাওয়া কিছুটা চোখে লাগে। বিশেষত যেখানে সাবইনস্পেক্টর ও কনস্টেবলরা উপস্থিত রয়েছে।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রথমেই আসবে মোশারফের কথা। বাংলাদেশে কেন তাঁকে স্টার অভিনেতার খেতাব দেওয়া হয় তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন গোটা সিরিজ়ে। প্রতিটি দৃশ্যে তাঁর শরীরীভাষা এতটাই সহজ, সাবলীল ও স্বাভাবিক যে অভিনয় বলে মনেই হয় না। আফনানের ভূমিকায় শ্যামলের অভিনয়ও এক মুহূর্ত তার প্রতি দর্শকের ঘৃণাকে কম হতে দেয় না। মলয়রূপী ইমরান অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে পর্দায় নিজেকে তুলে ধরেছেন। শাহানার চরিত্রে জ়াকিয়াও যথাযথ। আবির চরিত্রের জড়তা, বিভ্রান্তি ও অসহায়তা সুন্দরভাবে ফুটিয়েছেন খায়রুল।
এই সিরিজ়ের চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনা প্রশংসার দাবি রাখে। জ়াহিদ নীরবের আবহসঙ্গীত আলাদা রেশ রেখে যায়। সব মিলিয়ে টানটান চিত্রনাট্যে থ্রিলার গোত্রের এই সিরিজ়টি দর্শকের ভালো লাগতে বাধ্য। এমন অকারণ-আবেগবর্জিত, সোজাসাপটা গল্প বলার ধরণকে বাংলা ওয়েব সিরিজ়ের দুনিয়ায় স্বাগত। দ্বিতীয় সিজ়নের অপেক্ষা থাকবে।