সেফ খেললেন কৌশিক
ছবি: অযোগ্য
পরিচালনা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
অভিনয়ে: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শিলাজিৎ মজুমদার, লিলি চক্রবর্তী, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৬ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆
প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা (Prosenjit-Rituparna) জুটির পঞ্চাশতম ছবি। ‘অযোগ্য’ মুক্তির আগে এটাই ছিল ছবির সবথেকে বড় বিজ্ঞাপন। নব্বই দশকের প্রথম ভাগে ‘নাগ পঞ্চমী’ থেকে শুরু করে একটার পর একটা বক্স অফিস হিট দিয়ে এই জুটির জনপ্রিয়তা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল সেটা আন্দাজ করা এই প্রজন্মের পক্ষে সম্ভব নয়। পর্দার রসায়নের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের আঁচও চিরকাল এই জুটিকে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। সেই বহুশ্রুত অথচ অস্পষ্ট আঁচকে কাজে লাগিয়েই মুক্তি পেল পঞ্চাশতম ছবিটিও। কতটা উত্তাপ ছড়াতে পারল ‘অযোগ্য’, দেখা যাক।
মধ্যবয়সে এসে হঠাৎ চাকরি হারিয়ে অসহায় রক্তিম (শিলাজিৎ) ক্রমশ নেশা আর হতাশায় ডুবে যেতে থাকে। এরই মধ্যে স্ত্রী পর্ণার (ঋতুপর্ণা) চাকরি পাওয়া সাময়িক স্বস্তি দিলেও আহত পৌরুষের তাড়নায় বেসামাল হয়ে যেতে থাকে রক্তিম। একদিন ঘটনাচক্রে তার আলাপ হয়ে যায় প্রসেনের (প্রসেনজিৎ) সঙ্গে। সফল ব্যবসায়ীকে বন্ধুরূপে পেয়ে কিছুটা আশা জাগে যেন রক্তিমের মনে। একদিন তাকে বাড়িতে নিয়ে এলে দেখা যায় পর্ণা এবং প্রসেন পূর্বপরিচিত। গল্প বাঁক নেয় অন্যদিকে।
ছবির বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব নেই। ত্রিকোণ সম্পর্কের এই সমীকরণ এর আগেও বহু ছবিতে নানা আঙ্গিকে এসেছে। কিন্তু অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই ত্রিকোণমিতিকে যথেষ্ট পরিণতভাবে সামলেছেন কৌশিক। আবেগ থাকলেও তার বহিঃপ্রকাশে কোথাও বাস্তবিক মাত্রাজ্ঞান কমে যায়নি। জীবনের মধ্যগগনে এসে একজন কর্মঠ পুরুষের জীবিকাহীনতার যে করুণ পরিস্থিতি এবং তার পরেই অবধারিতভাবে ইগো সমস্যা, এতে পলিটিক্যাল কারেকটনেস না থাকতে পারে, বাস্তব আছে। শুনতে মিসোজিনিস্টিক লাগতেই পারে। তবু এখনও বেশিরভাগ ভারতীয় পুরুষ স্ত্রীর চাকরির ওপর ভরসা করে সংসার সামলাতে পারেন না। হাউজ়ওয়াইফ হয়ে একজন মহিলা যে দায়িত্ব অবলীলায় এবং আনন্দের সঙ্গে পালন করে চলেন, একজন পুরুষ তা সজ্ঞানে মেনে নিতেও পারেন না। হাউজ়-হাসব্যান্ড আজও ভারতের মতো দেশে এক অপমানকর পরিস্থিতি, লুকিয়ে রাখার বিষয়। ছবির এই পর্যায় মধ্যবিত্তকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই।
আরও পড়ুন: সলমনের বদলে ‘প্রেম’ কার্তিক?
শিলাজিৎ অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে রক্তিমকে এক রক্তমাংসের চরিত্র করে তুলেছেন। তিনি মুখের রেখায় অভিনয়কে বহন করতে জানেন। এ ছবির ভরকেন্দ্র তিনিই। ‘নীহারিকা’র পর শিলাজিৎ আবারও প্রমাণ করে দিলেন যে কোনও চরিত্রে তিনি সাবলীল। তবু বাংলার পরিচালকেরা কেন আজও তাঁকে সেইভাবে ব্যবহার করলেন না, এ এক রহস্য।
পরবর্তী পর্যায় কিছুটা অতিনাটকীয় হলেও গল্পের খাতিরে মেনে নিতে মন্দ লাগে না যে একদিন সব হিসেব মিলে যাবে। যদিও বাস্তব এতটা মসৃন আর সহায়ক হয়ে ওঠে না সবার জন্য। দুর্ভাগ্য এত সহজে মানুষকে ছেড়ে যায় না। আর প্রতিশোধস্পৃহা এত অনায়াসে মোলায়েম কার্পেট বিছিয়ে দিতে দেয় না। ঘটনার ওঠাপড়া সর্বত্র এক চাপা টেনশন রেখে দিয়েও সহজ সমীকরণে স্বস্তি দিচ্ছিল। তবু সবশেষে অঙ্ক মিলিয়ে দিতে গিয়ে ভয়ঙ্কর অতীতের অবতারণা এবং সেই সূত্রে প্রতিশোধ মাথা চাড়া দেওয়া এতক্ষণের বাস্তব ঘেঁষা গল্পকে হঠাৎ যেন ক্রাইম থ্রিলার বানিয়ে দেয়। তাছাড়া জীবনে কি সত্যিই সবকিছু এত মেপে, পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাওয়া যায়? কিছুটা কাকতালীয়ও হতে পারত না কি? হলে তবু কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতা থাকত। তাছাড়া প্রায় ভিক্ষে করে পাওয়া চাকরিতে পর্ণার অযোগ্যতা আগাগোড়া কোথাও চোখে পড়েনি।
আরও পড়ুন: আবারও বাংলা ছবিতে অনসূয়া?
প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণা দুজনকে ভেবেই এই কাহিনি লেখা হয়েছে সে কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। দুজনেই পরিণত অভিনয় করেছেন। শুধুমাত্র পঞ্চাশতম ছবি বলেই সাংঘাতিক কোনও রোমান্টিক রসায়ন তৈরি করতে চাননি কৌশিক। তাঁর পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। তাই একটিমাত্র চুম্বন দৃশ্য দেখতে আরোপিত লাগে না।কোথাও এতটুকু অতিঅভিনয় করেননি কেউ। হয়তো এটাই অভিজ্ঞ জুটি হওয়ার লক্ষণ। এই ষাটোর্ধ বয়সেও প্রসেনজিতের নায়কোচিত ব্যক্তিত্ব ও ফিটনেস মুগ্ধ করে। প্রসেন চরিত্রের রহস্য ও কাঠিন্যকে সুন্দরভাবে সামলেছেন তিনি।
ঋতুপর্ণা সাবলীল ও স্বাভাবিক। নিজের তারকা ইমেজ ভেঙে চরিত্র হয়ে উঠেছেন তিনি। পর্ণার সাজপোশাক এবং লুক এই ছবিতে অত্যন্ত সুন্দর ও ছিমছাম। সুদীপের চরিত্রটি ছবিতে খোলা হাওয়ার মতোই আরামদায়ক। বরাবরের মতোই বিশ্বাসযোগ্য অম্বরীশও, তবে তাঁর মতো অভিনেতাকে এত সাধারণ চরিত্রে দেখে মন ভরে না। প্রসেনের মায়ের চরিত্রে লিলি যথাযথ।
ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, অনুপম রায় ও রণজয় ভট্টাচার্যের সুরে ছবির গানগুলি শুনতে ভালো হলেও খুব একটা রেশ রেখে যায় না। পুরী এর আগেও কৌশিকের ‘দৃষ্টিকোণ’ ছবিতে এসেছে, আর কিছুটা একরকমভাবেই এসেছে। তাই কিছুটা যেন সেই ছবির স্মৃতি এনে ফেলে সমুদ্র সৈকতের দৃশ্য, যা হয়ত ইচ্ছাকৃতভাবেই তৈরি করা। সম্পর্কের গল্প, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার গল্প হয়তো সাধারণ দর্শক পছন্দই করেন, ছুটির দিনে তাই সিনেমাহল ভরিয়েই দেখতে গেছেন তাঁরা।
তবু একটা আক্ষেপ থেকেই যায়। এই মুহূর্তে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে বিষয় বৈচিত্র্যকে সামনে রেখে ছবি ও সিরিজ় তৈরি হচ্ছে সেখানে ‘শব্দ’, ‘বিসর্জন’ বা ‘নগরকীর্তন’-এর পরিচালক নাই বা এত সেফ খেললেন। কঠিন বিষয়ে ছবি করে দর্শককে ভাবিয়েছেন বলেই তাঁর কাছে অন্তত বাংলা ছবির দর্শক নতুন কিছু দাবি করতেই পারেন। আশা করি কৌশিক ভেবে দেখবেন। তবে হ্যাঁ, ‘অযোগ্য’ অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহে বসে দেখার যোগ্য ছবি।