কাল্পনিক হলেও আদর্শ ট্রিবিউট

ছবি: মায়াকুমারী

পরিচালনা: অরিন্দম শীল

অভিনয়ে:  ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, আবির চট্টোপাধ্যায়, অরুণিমা ঘোষ, রজতাভ দত্ত, ইন্দ্রাশিস রায়, সৌরসেনী মৈত্র, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২৯ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆

অরিন্দম শীল যে একজন দুঁদে পরিচালক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। থ্রিলার হোক বা রোম্যান্টিক, সব ধরণের ছবির ক্ষেত্রেই তিনি একপ্রকার সিদ্ধহস্ত। ফলত, বাংলা ছবির শতবর্ষকে ট্রিবিউট জানিয়ে তার নতুন ছবি ‘মায়াকুমারী’ নিয়ে আশা ছিল গগনচুম্বী। একঝাঁক তারকাখচিত এই ছবি তৈরি হয়েছে বেশ কিছু বছর ধরে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘেঁটে আমরা বহু পরিচালক অভিনেতার খ্যাতি সুনামের গল্প জেনেছি। এই নিয়ে তৈরিও হয়েছে বিস্তর তথ্যচিত্র, বায়োপিক ও ফিকশনাল ছবি। কিন্তু ইতিহাসের সবটাই কি শুধুই রঙিন? তার কোনও অন্ধকার দিকই কি খুঁজলে পাওয়া যাবে না? সেই খোঁজই অরিন্দম করেছেন এই ছবিতে। কমেডির মোড়কে অদ্ভুতুড়ে আবহাওয়ায় তুলে ধরেছেন বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের এমনই এক দিক যা হয়তো সত্যিই কখনও কোথাও হয়ে থাকতেও পারে।



নির্বাক ও টকি যুগের খ্যাতনামা জুটি মায়াকুমারী (ঋতুপর্ণা) ও কাননকুমার (আবির)। দর্শকের ভালোবাসায় তারা হয়ে উঠেছিলেন মায়া-কানন। একের পর এক সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েও হঠাৎই একদিন অভিনয় জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ময়াকুমারী। পত্রপত্রিকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। শোনা যায় প্রখ্যাত গীতিকার স্বামী শীতল ভট্টাচার্যের (রজতাভ) কারণেই নাকি ছবির জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন মায়াকুমারী। আদতে কী হয়েছিল তার খোঁজ রাখেনি কেউ। পরিচালক সৌমিত্র মল্লিক (ইন্দ্রাশিস) তার নতুন ছবি ‘মায়াতরুর সংসার’ বানাতে চলেছেন এই মায়াকুমারীর জীবনী অবলম্বনে। তার ছবিতে কাননকুমারের ভূমিকায় অভিনয় করছেন সেই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার নাতি আহির চট্টোপাধ্যায় (আবির)। সৌমিত্রের কথায় আহিরের মুখ নাকি দাদুর মুখ কেটে বসানো। অন্যদিকে মায়াকুমারীর চরিত্রে নতুন মুখ অরুণা (অরুণিমা) ওরফে রুনি একদমই আনকোরা।

আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান

এতক্ষণ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। গোলমাল শুরু হল ‘ছায়া-শীতল’ বাড়িতে ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে। অরুণার আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন এল। হাবেভাবে, চালচলনে সে যেন হঠাৎই অবিকল মায়াকুমারী হয়ে উঠল। প্রথমদিকে ইউনিটের লোকজন ব্যাপারটাকে মেথড অ্যাক্টিংয়ের তকমা দিলেও ক্রমে সকলেই অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়ে। ঠিক কী কারণে অরুণার এই পরিবর্তন সেটা খোলসা হয় ছবির দ্বিতীয় ভাগে। সকলে এমন এক অদ্ভুত সত্যের মুখোমুখি হয় যা পাল্টে দেয় দীর্ঘদিনের ইতিহাস।

ছবি ভালো লাগার প্রথম কারণ অবশ্যই শুভেন্দু দাশমুন্সির চিত্রনাট্য। বাংলা ছবির এমন বহু অজানা তথ্য তিনি তুলে এনেছেন যা ফিল্মবাফদের জন্য  আদর্শ। ‘মায়াকুমারী’ মিউজ়িক্যাল ছবিও বটে। এমনকি বেশ কয়েকবার উঠে এল উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন প্রসঙ্গ। কাননকুমারকে কুমার সাহেব বলে ডাকার প্রসঙ্গে মনে পড়ে প্রমথেশ বড়ুয়ার কথা। আবার মায়াকুমারীর শেষ ছবি ‘প্রণয়ের পরিণাম’ এর সঙ্গে নামের মিল রয়েছে ‘প্রণয়পাশা’র।

আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন

বিক্রম ঘোষের পরিচালনায় এগারোটি গান রয়েছে ছবিতে। শুরুতেই ‘মধুমাসে ফুল ফোটে বাগানে কাননে’, ‘প্রেমে যদি এতই কাঁটা’, ‘চোখের জলে সাগরের স্বাদ সাগর ভালো লাগে’ এবং ‘ওলো সই বল দেখি তুই সে আমি কে’, এই চারটি গান প্রিলুড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যেক সঙ্গীতশিল্পী নিজ স্বকীয়তায় তাঁদের কণ্ঠে পুরনো দিনের আমেজ ধরে রাখতে পেরেছেন। এই ছবিতে মেকআপের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে সোমনাথ কুণ্ডুর করা প্রস্থেটিক নিয়ে খুব একটা সাবলীল হননি অভিনেতারা। এই জায়গায় আরও একটু যত্নশীল হলে ভালো হতো।

ছবির মধ্যে ছবি নির্মাণের গল্প নতুন নয়। বরং ষাট-সত্তর দশকে ছবি নির্মাণ করতে গেলে যে ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো, আজ আর তা হয় না। একটা সময় শট দেওয়ার পর কেমন হলো, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হতো তিন-চার মাস। সেই ট্রানজ়িশনটি ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে ‘মায়াকুমারী’তে। দ্বৈত চরিত্র হলেও কাননকুমার এবং আহিরের চরিত্রের শেডস আলাদা। এই জায়গায় দুজনের একবারে ভিন্ন শরীরী ভাষা আলাদাভাবেই উপস্থাপন করেছেন আবির। অরুণিমার অভিনয় আরও একবার সেই একই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়, কেন আরও বেশি ছবিতে পাওয়া যায় না তাঁকে? ঋতুপর্ণার অভিনয় কিছুটা চড়া দাগের যা সেই যুগের কাননকুমারীর অভিনয়ের সঙ্গে মানানসই।



তবে অভিনয়ের দিক থেকে যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি রজতাভ। ডাকসাইটে সুন্দরী অভিনেত্রীর স্বামীর চরিত্রে তিনি তার নামের মতোই শীতল। বহুদিন পর রজতাভকে এ ধরণের কোনও চরিত্রে দেখা গেল। সৌমিত্রের স্ত্রীর ভূমিকায় ফলককে আরও পরিশ্রম করতে হবে অভিনয়ের ক্ষেত্রে। ছবির আরও দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে সাবলীলভাবে উতরে গেছেন অর্ণ ও সৌরসেনী। যদিও অর্ণকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যেত।

ছবির দৈর্ঘ্য একটু বেশি। প্রথমার্ধে পরিচালক তাঁর নিজ ছন্দে একটি থ্রিলারের আবহাওয়া এনেছেন যা উন্মোচিত হয়েছে দ্বিতীয়ার্ধে। তবে দ্বিতীয়ার্ধের গতি আর একটু বেশি হলে ভালো হতো। ক্যামেরার কাজে শুভঙ্কর ভড় প্রশংসনীয়। এছাড়া ছবির বিরতি কার্ডটিতে বেশ অভিনবত্বের ছোঁয়া আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, শতবর্ষ পরে হলেও তাঁর কবিতা পড়ার অভাববোধ হবে না কখনওই। বাংলা ছবির ইতিহাসেরও শতবর্ষ অতিবাহিত। সেই ইতিহাস জানার ইচ্ছা বহু দর্শকের। এই ছবির মাধ্যমে এমনিও বহু মায়াকুমারী-কাননকুমারকে স্মরণ করল বাংলা সিনেমা। সেদিক থেকে দেখলে, কাল্পনিক হলেও ‘মায়াকুমারী’ এক আদর্শ ট্রিবিউট জানাল বাংলা ছবিকে।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *