সিনেমা থাকছেই, মত সব প্রজন্মের
কলকাতা: “জিতে গেছে সিনেমাই। কারণ আলোচনার বিষয়টাই তো সিনেমা নিয়ে, তার ভাষা কবে না বদলেছে? যদি ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মের কারণে সিনেমার বিপন্নতা নিয়ে কথা ওঠে, তাহলে বলা যায় যখন টেলিভিশন এসেছিল তখনও একই প্রশ্ন উঠেছিল। আবার নব্বইয়ের দশকে ভিডিও পাইরেসি এসেও এই একই প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু সিনেমা শুধু যে বাঁচল তা নয়, সে সব দিক দিয়ে আরও শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠল,” বললেন পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। বিতর্ক ছিল ডিজিট্যাল (ওটিটি) মাধ্যম সিনেমার ভাষাকে বদলে দিচ্ছে কি না। ১০ জানুয়ারি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মুক্ত মঞ্চে পক্ষে ও বিপক্ষে মত দিলেন সিনেমা ও ডিজিট্যাল মাধ্যমের একঝাঁক তারকা।
করোনা অতিমারীর কারণে মাসের পর মাস থমকে গিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বন্ধ ছিল প্রেক্ষাগৃহও। এমন অবস্থায় মুঠোয় ধরা স্মার্টফোনে ছবি ও ওয়েব সিরিজ় দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেলন অনেকেই। তাহলে কি ভবিষ্যতে ওয়েব সিরিজ় সিনেমাকে ছাপিয়ে যাবে? সিনেমার ভাষাও কি তবে ওয়েব সিরিজ এসে বদলে দিচ্ছে?
বড়পর্দায় ‘গুপ্তধন’ সিরিজ়ের পরিচালক ধ্রুব প্রশ্ন তুললেন, “বর্তমানে কোন বিষয়ের স্পেশালাইজ়েশন নেই? একজন চিকিৎসকও কোনও না কোনও বিষয়ে স্পেশ্যালাইজ় করেন। এটাও সেরকমই। সিনেমা দেখার ক্ষেত্রটা বেড়ে গেছে, কন্টেন্ট বেড়েছে। একে সিনেমার দুর্দিন কিছুতেই বলা যায় না। শুধু কোথাও এই দেখার মজাটা ব্যক্তিগত, কোথাও সেটা সর্বজনীন।”
আরও পড়ুন: জটায়ুর সাহস
ডিজিট্যাল মাধ্যমের সফল পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী মনে করেন, “ওটিটি এমন একটা জিনিস যেটা আমরা সময়সাপেক্ষে দেখতে পারি। ওয়েব সিরিজ় একটা একক অভিজ্ঞতা, যেটা আমরা বইয়ের ক্ষেত্রে পাই। এছাড়া ডিজিট্যাল মাধ্যমে এমন অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করা যায় যা হয়ত সিনেমায় দেখানো যেত না। কন্টেন্টের দিক থেকে ওটিটি অনেক বেশি শক্তিশালী।”
তবে যে কোনও মাধ্যমে পরিবর্তন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেখানে ওটিটিকে একটা নতুন প্রাপ্তি বলে মনে করেন ‘ধানবাদ ব্লুজ়’ ও ‘শব্দজব্দ’র পরিচালক সৌরভ। “প্রেক্ষাগৃহ একটা নির্দিষ্ট দিনের পর সিনেমাটা পাল্টে দেবে। ওটিটিতে সেখানে কন্টেন্টকে অসীম পর্যায়ে নিয়ে যায়। সেটা যে কেউ যখন ইচ্ছে দেখতে পারে,” বললেন তিনি।
টেলিভিশন দিয়ে কেরিয়ার শুরু করে ছবির জগতে তারকায় পরিণত হওয়া আবির এখনও ডিজিট্যাল মাধ্যমে কাজ করেননি। তাঁর মতে, “সিনেমার ভাষা সময়ের সঙ্গে পাল্টাবেই। ওটিটি এসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার একটা জায়গা তৈরি করেছে বলা যায়। তবে সিনেমায় একটা কমিউনিটি ফিলিং তৈরি হয়। যে মানুষটাকে আমি চিনি না তার সঙ্গে একই সময়ে একসঙ্গে আমরা হাসছি ও কাঁদছি। এই জিনিসটা ডিজিট্যাল মাধ্যম কখনও দিতে পারবে না।”
আরও পড়ুন: সুরের স্মরণিকায় দেবজ্যোতির সৌমিত্র স্মরণ
ডিজিট্যাল মাধ্যমে এখনও পদার্পন না করা অভিনেতা অর্জুন চক্রবর্তী মনে করেন, “ফোনে ছবি দেখা মানে একাধিকবার উঠে যাওয়া। এতে গল্পটা বাধা পায়। ওটিটিতে একটা ছবি দিয়ে দেওয়া মানে পরিচালকও জানেন বেশিরভাগ মানুষ সেটা ফোনে দেখবেন। কিন্তু একটা ভালো ছবি, যেটা বড় পর্দার জন্য তৈরি, সেটা প্রথমবার ফোনে দেখা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের।”
দীর্ঘদিন সিঙ্গল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহ চালাবার অভিজ্ঞতা থেকে অরিজিৎ দত্ত জানালেন, “সিনেমা ও ওয়েব মাধ্যম দুটি একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হলেও ‘শোলে’, ‘সাউন্ড অফ মিউজ়িক’ বা ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’র মতো ছবি ছোট পর্দায় কিছুতেই সিনেমাহলের অনুভূতি দিতে পারবে না। ওটিটির ছবি আলাদা। অন্ধকার হলে, নায়ক পর্দায় আসার সময় দর্শকদের সমবেত উল্লাস, পয়সা ছোঁড়া, অনেক মানুষের একসঙ্গে দেখার যে আনন্দ, সেটা একা দেখায় কিছুতেই আসতে পারে না।” তবে ডিজিট্যাল মাধ্যমের কারণে অনেক নতুন প্রতিভা উঠে আসছে সেটাও মনে করেন তিনি।
একইসঙ্গে থিয়েটার ও বড়পর্দায় অভিনয় করলেও নিজে সম্প্রতি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়েছেন ঋদ্ধি সেন। তিনি মনে করেন, “প্রযুক্তি পাল্টালেও সিনেমার ভাষা পাল্টায়নি। বলার মাধ্যমটা পাল্টেছে। একটা সময় ওটিটিতেও সেন্সরশিপ আসবে। ওটিটির শেলফ লাইফ আছে। তবে অভিনয়ের খুঁটিনাটি বড় পর্দাতেই দেখতে হবে। একজন ফলি আর্টিস্টের কাজ, বা কালারিস্টের দক্ষতা ফোনের স্ক্রিনে বোঝা সম্ভব নয়। সিনেমার ভাষা ওটিটি এসে পাল্টায়নি। বিভিন্ন ফরম্যাটে বরং সেটা আগেই পাল্টেছে।”
বড়পর্দার গ্রহণযোগ্যতা যে থাকছেই সেটা মেনে নিচ্ছেন সকলেই। “এটা একটা বিশেষ সময়,” বললেন ধ্রুব। সিনেমাহল বন্ধ ছিল বা কম খুলেছে বলেই ওটিটি বনাম প্রেক্ষাগৃহ এই বিষয়টা উঠে আসছে। এ বছরেই ছবিটা পাল্টে যাবে। কাজেই একটা বিশেষ সময়ের ওপর ভিত্তি করে কোনও মতামত দেওয়া উচিত নয়।”
ছবি: গার্গী মজুমদার