রোগটা কিসের ছিল, নিঃশ্বাসের না বিশ্বাসের?
ছবি: কালকক্ষ
পরিচালক: রাজদীপ পাল, শর্মিষ্ঠা মাইতি
অভিনয়ে: তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস, জনার্দন ঘোষ, শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায়, অহনা কর্মকার, অমিত সাহা, দীপ সরকার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৭ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
বছর দুয়েক আগের কথা। এক অজানা রোগ কেমন যেন হুড়মুড়িয়ে আমাদের রোজকার জীবনে ঢুকে পড়ল। হঠাৎ করেই ঘোষণা করা হলো লকডাউন। শুরু হলো অকল্পনীয় এক বন্দিজীবন। একদিকে ক্রমশ বাড়তে থাকা অতিমারীর আতঙ্ক, অন্যদিকে লকডাউনের একঘেয়ে জীবনে প্রতিদিন আরও একটু করে তলিয়ে যাওয়া। এর সঙ্গে বিনামূল্যে প্রাপ্তি প্রতিদিন বেড়ে চলা মৃত্যু সংবাদ। জীবনে কোনও লক্ষ্য নেই, আশা নেই। শুধু একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আগামীর অপেক্ষা করে যাওয়া, আর নয়তো মৃত্যুর কালো ছায়ার হাতে অসহায় সমর্পণ। দিনের পর দিন বাক্সবন্দী জীবনে একটু-একটু করে হতাশার অন্ধকূপে হারিয়ে যাওয়া।
গত দু’বছরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষর রয়ে গেছে আমাদের স্মৃতিতে। ‘কালকক্ষ’ দেখতে বসে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি ফিরে আসতে বাধ্য। শহরের এক ব্যস্ত ডাক্তারকে (জনার্দন) অপহরণ করে একটি মেয়ে (তন্নিষ্ঠা)। কারণ তার বাড়িতে অসুস্থ মা ও ছোট মেয়ে রয়েছে। ডাক্তার ছাড়া তাদের চলবে না। বন্দী অবস্থায় ডাক্তার ক্রমশ পরিচিত হতে থাকেন এই পরিবারের তিন সদস্যের সঙ্গে। মেয়েটির নাম মামনি। তার অসুস্থ মাকেও (শ্রীলেখা) সে মামনি বলেই ডাকে। আবার ছোট মেয়েটির নামও মামনি (অহনা)। বাড়ির তিন সদস্যের প্রত্যেকেই একে অপরকে একই নামে ডাকে। এদের ভূমিকা আলাদা হলেও পোশাক একইরকম, ধূসর রঙের। শুধু প্রতিদিন সন্ধ্যায় আরতির সময় সেই পোশাক বদলে যায়। ডাক্তার পালাবার চেষ্টা করেও সফল হয় না। একটা সময় সে আবিষ্কার করে পুরো ঘটনাটাই চলছে একটা টাইম লুপে। একইভাবে প্রত্যেকটা দিন যায়, রাত আসে। পড়াশোনা করা, পাড়ায় বাজার আসা, উল বোনা, দুপুরে ঝোলভাত খাওয়া, তিন প্রজন্মের দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে অসুস্থ হওয়া সবটাই হয় রুটিন মেনে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য প্রতিদিন একই ভাষা একই শব্দের পুনরাবৃত্তি করে চলে।
এই টাইম লুপে শুধু একটাই পরিবর্তন আসে। টেলিভিশনে সংবাদ পাঠকের কণ্ঠে শুধু বদলে যায় দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা, এক হাজার থেকে বাড়তে-বাড়তে লাখের ঘর ছুঁয়ে ফেলে পরিসংখ্যান। লাফিয়ে বাড়তে থাকে মৃত্যুহারও। শুধু ডাক্তার চেষ্টা করে গল্পটাকে প্রতিদিন একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে। হয়তো সে নিজেও বদলায় একটু-একটু করে। কিন্তু দু’পা এগোলে তিন পা পিছিয়ে এসে রোজ সকাল শুরু হয় আবার পুনর্মূষিক ভব হয়ে।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
এই অনন্ত জাল কেটে বেরোবার রাস্তা নেই। আসলে তো ঘড়ির হিসেবটা দিনে রাতে ১২ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ। দিনগুলোকে আমরা আলাদা করে তুলি কাজের মাধ্যমে, নানা ঘটনা, বিশেষ তারিখ, স্মৃতি, আশা, আনন্দ কিংবা মনখারাপ দিয়ে। কিন্তু যেখানে জীবনের এই ওঠাপড়া নেই, বেঁচে থাকার কোনও উদ্দেশ্য নেই, সেখানে জীবন আর মৃত্যুর তফাৎ কিসে? জীবন যেখানে মৃত্যুর ভয়ে থমকে যায়, সেখানে পালিয়েই বা যাব কোথায়? যেখানে নিঃশ্বাসেও মৃত্যু ছড়ায়, সেখানে দম আটকে মরে যাওয়া ছাড়া তো আর পথ নেই।
করোনাকালের এই মর্মান্তিক সত্যকে নির্মমভাবে তুলে ধরেছে ‘কালকক্ষ’। পালাবার কোনও পথ ছিল না সেদিন। সারা পৃথিবীটাই একটা অন্ধকূপ হয়ে উঠেছিল। টাকা, প্রতিপত্তি, যশ, খ্যাতি, কিছুই সেদিন কাজে আসেনি। মৃত্যুর পর মর্গে সব দেহ সমান। বরং অর্থহীন, আশ্রয়হীন, পরিযায়ী শ্রমিকের দল রাষ্ট্রের চরম অবহেলায় মরতে-মরতে একদিন মৃত্যুকেও জয় করে ফেলে। একে-একে ফিরে আসে তারা যে যার বাড়িতে। সেখানেও অনাহার, অর্থাভাব কিংবা মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে জেনেও। লড়ে যেতে হবে, ভেঙে পড়লে চলবে না।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
এক পর্যায়ে গিয়ে ছবির গল্প ও তার নির্মাণ দর্শকের স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য। দেখতে-দেখতে মনে হবে আমরাও আটকে গেছি ওই সময়ের অনন্ত চক্রে, বেরোবার কোনও রাস্তা নেই। বলা বাহুল্য দর্শককে এই উপলব্ধিতে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব দুই পরিচালকের। উপযুক্ত সঙ্গত রয়েছে চিত্রনাট্যকার, আবহ সঙ্গীতকার, চিত্রগ্রাহক এবং অভিনেতাদের। দু’ঘন্টার ছবির মাধ্যমে তথাকথিত বিনোদনের সব মালমশলা বাদ দিয়েও দর্শকের নিজস্ব দর্শন বা চিন্তা জগতে ছাপ ফেলে যাওয়া মুখের কথা নয়। অভিনেতারা প্রত্যেকে নিজের জায়গায় অনবদ্য। বিশেষভাবে বলতে হয় তন্নিষ্ঠা ও জনার্দনের কথা। ছোট্ট চরিত্রেও অমিত বরাবরের মতোই উজ্জ্বল।
পোশাক পরিকল্পনা ও শিল্প নির্দেশনা বিভাগের আলাদাভাবে প্রশংসা প্রাপ্য ছবির আবহ সৃষ্টিতে। পরিমিত ও পরিকল্পিত আলোর ব্যবহার একটা অস্বস্তিকর অন্ধকার পরিবেশের সৃষ্টি করে যা কাহিনীর বিন্যাসে সহায়তা করেছে। অভিজিৎ কুণ্ডুর সঙ্গীত পরিচালনা ছবির সঙ্গে মানানসই। ছবির একটিমাত্র গান, যেটা সম্ভবত তন্নিষ্ঠা নিজেই গেয়েছেন, শুনতে ভালো লাগে।
কঠিন বিষয় ও জটিল ভাবনার কারণেই ‘কালকক্ষ’ এই সময়ে মুক্তি পাওয়া আর পাঁচটা ছবির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এ কথা যেমন সত্যি, তেমন এও সত্যি যে এই ছবি সকলের জন্য নয়। তবু ‘কালকক্ষ’ বর্তমান প্রজন্মের জীবনকালে সম্ভবত সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার দলিল, এ কথা অস্বীকার করা চলে না।